শফিউদ্দিন সরদার
রফিক খুব গরীব ছেলে। তার ভাল নাম রফিকুল ইসলাম। বড়ই সুন্দর তার চেহারা। দেখতে একদম রাজপুত্রের মতো। কিন্তু তার বাপ-মা কেউ নাই। জমিজমাও নাই, টাকা-পয়সাও নাই। কষ্টে শিষ্টে তার দিন চলে। খড়ের একটা ঘরে একাই থাকে রফিক। খুব সাহসী ছেলে তো! তাই সে ভয় পায় না একা থাকতে।
রফিকের বাপ কিন্তু মোটেই গরীব ছিল না। অনেক তার জমি ছিল। প্রচুর ধান-গম হতো সেই জমিতে। ধান গম বেছে অটেল পয়সা পেতো রফিকের বাপ। সে বেশ বড় লোক ছিল।
কিন্তু এর মধ্যে যে ঘটনা ছিল একটা। ঐ খানের জমিদার, মানে রাজা ছিল খুব বদ। জব্বোর খারাপ লোক। রাজার নায়েবটা ছিল আরো বদ। বদের হাড্ডি। রফিকের বাপ মারা গেলে ঐ ব্যাটা নায়েব তাদের সব জমি কেড়ে নিলো আর সে সব জমি ঐ গাঁয়েরই কয়েকজন বদলোককে দিয়ে দিলো। রফিক তখন ছোট। সে আর করবে কি? সেই থেকেই রফিক গরীব হয়ে গেল।
কিন্তু গরীব হলে কি হবে? গাঁয়ের ভাল লোকেরা রফিককে খুব ভাল বাসে। অমনি অমনি নয় কিন্তু। রফিক খুব ভাল ছেলে তো, তাই তারা ভালবাসে তাকে। রফিকের বাপও ছিল খুব ভাল মানুষ। রোজা রাখতো, নামাজ পড়তো, মিথ্যা কথা বলতো না, কারো ক্ষতি করতো না, দুঃখ দিতো না কারো মনে। রফিকটাও অবিকল তার বাপের মতো হয়েছে। সেও রোজা রাখে। নামাজ পড়ে, সত্যি কথা বলে আর সবার সাথে মিষ্টি ব্যবহার করে। কারো সাথে কখনই কোন বেআদবী করে না। এর উপর আবার রফিক দেখতেও খুব সুন্দর। এমন ছেলেকে কি ভাল লোকেরা ভাল না বেসে পারে? গাঁয়ের বেশীর ভাগ লোকই ভালবাসে রফিককে। আদর-যত্ন করে। বাড়ীতে পিঠে পুলি হলে তাকে ডেকে এনে খাওয়ায়। তা দেখে গাঁয়ের হিংসুটে আর বদলোকেরা জ্বলে পুড়ে মরে।
গাঁয়ের ভাল লোকেরা রফিককে টাকা পয়সা আর ধান চাল দিয়ে সাহায্য করতে চায়। রফিক তা নেয় না। সে বলে, বসে বসে অন্যের সাহায্য খাওয়া গুনাহর কাজ। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া মানুষের সাহায্য খেয়ে চিরদিন বেঁচে থাকা যায় না। সাহায্য খাওয়ার বদলে খেটে খাওয়াই উত্তম। সাহায্যের অন্নের চেয়ে নিজের উপায় করা পয়সার অন্ন অনেক বেশী মিষ্টি।
রফিক ভাই পরিশ্রম করে। মজুর খাটে বাড়ী বাড়ী। কাঠ ফাড়ে, মাটি কাটে, জমি চষে, পানি বয়। সে যখন যে কাজ নেয়, তাই করে। কোন কাজকে ছোট মনে করে না। এদিকে আবার রফিক খুব সৌখিন ছেলে। যেদিন কোথাও কোন কাজ না পায়, সে দিন বাড়ীতে সে ফুলের বাগান করে।
একদিন সে কি এক কাজে জংগলে গেল। জংগলে গিয়ে দেখে সেখানে ছোট্ট একটা ফুল গাছে সুন্দর একটা ফুল ফুটে আছে। ফুলটা দেখতেও যেমন সুন্দর গন্ধও তেমনই চমৎকার। রফিকের ইচ্ছে হলো, এই সুন্দর ফুলগাছটাও সে নিয়ে গিয়ে তার ফুল বাগানে লাগাবে।
যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। তখনই সে বাড়ীতে ছুটে গিয়ে কোদাল নিয়ে এলো। এরপর শিকড় আর মাটি সমেত ফুলগাছটা তুলে নেওয়ার জন্যে সে কোদাল দিয়ে মাটিতে খুব জোরে কোপ দিলো।
ওরে বাবা! কোপ দিয়েই চমকে উঠলো রফিক। কোপ দেওয়ার সাথে ঠং করে বিরাট এক শব্দ হলো। কিছু বুঝতে না পেরে আবার সে কোপ দিলো, অমনি ঠিক ঐ রকমই ঠং করে শব্দ হলো আবার। এবার সে বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই এখানে মাটির তলে কোন কিছু আছে। তাই সে আস্তে আস্তে সেখানকার মাটি সরিয়ে ফেলতে লাগলো। মাটি খানিকটা সরাতেই দেখে, হ্যাঁ- তার ধারণাই ঠিক। সেখানে একটা পিতলের কলসী পুঁতে রাখা আছে। তখনই সে কলসীটা তুলে ফেললো। কলসীর মুখটা ঢাকনা দিয়ে শক্ত করে আঁটা। জাগাতে গিয়ে দেখে, কলসী বেশ ভারী।
রফিকের আনন্দ তখন দেখে কে? সে বুদ্ধিমান ছেলে। সে বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই এই কলসীর মধ্যে মোহর, মানে সোনার টাকা আছে। আগেকার দিনের রাজা বাদশাহরা এমনি করেই সোনার মোহর কলসী ভরে পুঁতে রাখতো মাটিতো। নসীবের জোরে এমনই একটা মোহরভরা কলসী আজ সে পেয়ে গেছে। রফিকের মনে আনন্দ আর ধরে না।
তখনই সে ভাবলো, কলসীর মুখ এখানে খুললে অন্য লোকে তা দেখে ফেলতে পারে। লোকে এই সোনার টাকা দেখলে আর রক্ষে নেই। চুরি ডাকাতি করে সব নিয়ে নেবে বদ লোকেরা। তার চেয়ে কলসীটা চুপি চুপি বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া ভাল। ঘরে দুয়ার দিয়ে খুললে আর কেউ দেখতে পাবে না।
তাই করলো রফিক। কলসীটা বাড়ীতে নিয়ে এলো। এরপর ঘরে দুয়ার দিয়ে খুলতে লাগলো কলসীর মুখের ঢাকনা। মনটা তার আনন্দে দুলছে তখন। এখনই সে এক গাদা সোনার টাকা দেখতে পাবে।
কিন্তু একি! ওরে বাপরে বাপ! কলসীর মুখের ঢাকনাটা যেই সরিয়ে ফেললো। অমনি কলসীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো দাউ দাউ আগুন। সে আগুনের শিখা j¤^v হয়ে উঠতে উঠতে তার খড়ের ঘরের চালে একদম ঠেকা ঠেকা হয়ে গেল। এই বুঝি পুড়ে যায় ঘরটা তার। হুঁশবুদ্ধি হারিয়ে চেয়ে রইলো রফিক।
এরপর আর এক কাণ্ড। চোখের পলক ফেলতেই রফিক অবাক হয়ে দেখলো, সে আগুনটা আর নেই। আগুনটা এর মধ্যেই দৈত্যের মতো বিশাল আর ভয়ংকর একটা মূর্তি হয়ে গেছে। মূর্তির মাথায় ইয়াব্বড়ো মোটা মোটা দুই শিং। খড়ের গাঁদার মতো মাথা ভর্তি এক গাদা কোঁকড়ানো চুল। জ্বলন্ত চুলার মতো বড় বড় দুই চোখ। মুখ ভর্তি দাঁড়ি আর মোটা মোটা দাঁত। হাত-পায়ের নখগুলো ছুরির মতো লশ্বা আর হাত-পা ও গা ভর্তি গাদা গাদা লোম। পাটা তার মাটিতে আর মাথাটা ঘরের চালে ঠেকা ঠেকা।
পায়ের কাছে বসা রফিকের দিকে চেয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো মূর্তিটা। অন্য কোন ছেলে হলে ভয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়তো মাটিতে। কিন্তু রফিক খুবই সাহসী ছেলে। ভয় পাওয়ার বদলে সে কটমট করে চেয়ে রইলো মূর্তিটার মুখের দিকে এবং শব্দ করে কলেমা পড়তে লাগলো। একটার পর একটা কোরান শরীফের লাইন গড় গড় করে বলে যেতে লাগলো।
তা দেখে শব্দ করে হাসা বন্ধ করলো মূর্তিটা। শব্দ করে না হেসে অল্প হেসে বললো- সাব্বাস বেটা! তুমি কোরআন শরীফ পড়তে জানো দেখছি। আমিও কোরআন শরীফ পড়তে খুব ভালভাসি।
মূর্তিটাকে কথা বলতে দেখে রফিক তখনই প্রশ্ন করলো- কে তুমি? ভূত প্রেত বলে তো কিছু নেই। তুমি জীন, না যাদকুর? যাদকুর হলে আর কোরআন পড়বে কি?
মূর্তিটা ফের হেসে বললো- নারে বেটা, না। আমি কোন যাদুকর নই। আমি একটা জীন। তোমার মতোই আমি আল্লাহর এক বান্দা।
রফিকও ফের প্রশ্ন করলো- জীন তো এখানে কে?
জীনটা বললো- আমি ঐ কলসীর মধ্যে বন্দি ছিলাম রে বাপ। ভুল করে একটা গুনাহ করে ফেলেছিলাম তো! তাই এক আল্লাহভক্ত দরবেশ আমাকে এই কলসীর মধ্যে ভরে ঐ জঙ্গলে পুঁতে রেখেছিল। দরবেশ সাহেব বলেছিলেন, কোন ঈমানদার ছেলের নজরে যেদিন পড়বে, সেই দিন তুমি মুক্তি পাবে, তার আগে নয়। এখন দেখছি, তুমিই সেই ঈমানদার ছেলে। তোমার নজরে পড়ায় আমি এত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেলাম। সাব্বাস বাপজান। আমি খুব খুশি হয়েছি। বলো, তুমিকি চাও? যা চাইবে তাই পাবে তুমি।
এ কথায় রফিক খুশি হতে পারলো না। তার আশা ছিল, এখনই সে কলসী ভর্তি মোহরপাবে। কিন্তু মোহরের বদলে এই মূর্তি বেরিয়ে আসায় রফিকের মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই সে অভিমান ভরে বললো- না, না। আমি কিছুই চাই না। যা পাওয়ার আশা করেছিলাম, তা তো সব মিথ্যা হয়ে গেল। আর আমি চাইবো কি? আমি কিছু চাইনে। তুমি চলে যাও এখান থেকে।
জীন তার অভিমান বুঝতে পারলো। তাই নরম গলায় বললো- তবু একটা কিছু চাও বাপজান। তুমি আমার এত বড় উপকার করলে। তোমাকে তার পুরস্কার কিছু না দিয়ে আমি এখান থেকে যাই কি করে? দোহাই বাপজান, একটা কিছু চাও।
এ কথায় রফিক বিরক্ত হয়ে বললো- বটে! তাহলে হাতী ঘোড়ার শিং কিংবা ডিম আণ্ডা একটা কিছু দিয়ে তুমি দিয়ে হও এখনই।
জীনটা একটু চিন্তা করে বললো- ডিম আণ্ডা? ঠিক আছে। তাহলে এই ডিমটাই নাও তুমি।
এই বলে জীনটা তার পকেট থেকে বেলের মতো বড়ো সড়ো আকারের একটা ধবধবে সাদা ডিম বের করে রফিকের সামনে রাখলো এবং এর পরে সে মিলিয়ে গেল।
রফিক কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেই দেখলো, জীনটা আর সেখানে নেই, সে হাওয়া হয়ে গেছে। তার সামনে পড়ে আছে মস্তবড় এক ডিম। দুঃখের হাসি হেসে রফিক মনে মনে বললো- হুঁ! আশা করলাম মোহর আর পেলাম ডিম। খারাপ কপাল আর বলে কাকে!
কি আর সে করবে তখন! দুঃখিত মনে উঠে দাঁড়ালো রফিক। এরপর কলসীটা নিয়ে গিয়ে ঘরের এক কোনে রেখে ডিমটা তুলে রাখলো তাকের উপর।
সেদিন রফিক আর কোথাও গেল না। ভাতও রাঁধলো না। ভারী মনে সারাবেলা ঘরের বাইরে বসে বসে কাটালো। হাঁড়িতে সকালের কিছু শুকনো ভাত ছিল। রাত্রিকালে তাই খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটালো আর এশার নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়লো সকাল সকাল।
কিন্তু মন খারাপ থাকায় চোখে তার একটুও ঘুম এলো না। শুধু শুধুই চোখ বুঁজে সে পড়ে রইলো বিছানায়। এরপর মাঝরাতের দিকে আবার সে যারপর নেই চমকে গেল। চোখ মেলে দেখে আর এক জব্বোর কাণ্ড। তার আধার ঘরটা ভরে গেছে আলোতে। দিন বরাবর রোশনাই হয়ে গেছে তার ঘর। রফিক তাজ্জব হয়ে ভাবলো ঘটনা কি? আগুন টাগুন লাগলো নাকি তার ঘরে? কোথা থেকে আসছে এই আলো, সেটা দেখার জন্যে এদিক ওদিক চাইতেই রফিক দেখতে পেলো, আলো আসছে জীনের দেয়া ঐ ডিম থেকে। ডিমটা ফেটে দুইভাগ হয়ে গেছে আর ঐ ডিমের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। ডিমের ভেতরে সে ছোট হয়ে ছিল। ডিম থেকে বেরিয়ে এসেই সে এক পুরোপুরি যুবতী মেয়ে হয়ে গেল। রফিক আরো দেখলো, মেয়েটার রূপের আলোতেই ঘরটা এমন আলোকিত হয়ে গেছে।
এটা বুঝতে পেরেই রফিক আর নড়াচড়া করলো না। চাদর মুড়ি দিয়ে সে শুয়ে ছিল। চাদরের ফাঁক দিয়ে চুপি চুপি দেখতে লাগলো, এরপর কি হয়।
সে দেখলো, ডিম থেকে বেরিয়ে এসে মেয়েটি আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসে সে আবার ঐ ডিমের মধ্যে ঢুকলো। দুই ভাগ হয়ে যাওয়া ডিমের খোসাটা আবার জোড়া লেগে আগের মতোই নিখুঁত গোল ডিম হয়ে গেল। ডিমটার গায়ে ফাটা ফুটার কোন wPýB রইলো না।
এরপরে এক একদিন এক এক কাণ্ড ঘটতে লাগলো। পরের দিন রফিক দেখলো, তার ঘর দামী দামী আসবাব পত্রে ভর্তি। টেবিল-চেয়ার-আলনা, বাটি-বর্তন হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি নানা রকম my¯^v`y খাবার। এরপরে একদিন দেখলো, তার সেই নড়বড়ে চৌকিটা আর নেই। সেখানে সোনার পালকং পাতা আর পালংকের উপর গদী আঁটা রাজা-বাদশাহর বিছানা। এরপর দুই একদিন না যেতেই আবার সে দেখলো, তার টাকা পয়সারও কোন অভাব নেই। ঘরের কোনে রাখা জীনের ঐ কলসীটা সোনার টাকায় ভর্তি হয়ে আছে।
রফিক অবাক! ব্যাপার কি? কি করে হচ্ছে এসব? রফিক এর কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে একটা ব্যাপার ঠিক ঠিকই বুঝতে পারলো সে। সে বুঝতে পারলো- ডিম থেকে ঐ রূপসী মেয়েটা প্রতি রাতেই বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে মেয়েটা প্রায় রাতেই ঘরের বাইরে যায়। কোন কোন রাতে আবার রফিকের বিছানায় বসে ঘুমিয়ে থাকা রফিককে পাখা দিয়ে বাতাস করে। রফিক চোখ মেললেই অমনি মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে ঐ ডিমের খোসার মধ্যে ঢুকে। রফিক দেখে আর অবাক হয়। এইভাবে কয়েক দিন কাটলো। তারপর একদিন রফিক ভাবলো, প্রায় রাতেই মেয়েটা ঘরের বাইরে কোথায় যায়- তা তো একবার দেখতে হয়।
এই কথা ভেবে রফিকের ঘুম এলো না সে রাতে। ঘুমের ভান করে চোখ বুঁজে পড়ে রইলো বিছানায়। এরপর দুপুর রাতে মেয়েটা যেই বাইরে গেল, রফিকও উঠে চুপি চুপি তার পেছনে পেছনে বাইরে এলো। সে দেখলো, মেয়েটা বেশী দূরে গেল না। রফিকের বাড়ীর পাশেই অনেক দিনের একটা ভাঙ্গা মসজিদ ছিল। মেয়েটা এসে সেখানে দাঁড়ালো এবং শব্দ করে বললো- হুজুর আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে সেই জীনটা এসে মেয়েটার সামনে দাঁড়ালো এবং বললো- জি আম্মা, আমি আছি। বলো, আবার কি চাই?
আড়ালে দাঁড়িয়ে রফিক এ দৃশ্য দেখতে লাগলো।
মেয়েটি বললো- চাই মানে, ঘরে যে আর আসবাব পত্র ধরছে না হুজুর। এ ছাড়া, খড়ের ঘরে ওসব আসবাব পত্রও মানায় না। দালান ঘর না হলে-
জীনটা হেসে বললো- ও, এই কথা? ঠিক আছে, তুমি যাও। শিগগিরই ঐ ঘরটা এখানকার রাজ প্রাসাদের চেয়েও সুন্দর একটা প্রাসাদ হয়ে যাবে। বাড়ীটাও রাজবাড়ী হয়ে যাবে। খুশি তো?
মেয়েটা হেসে বললো- জি হুজুর, খুশী।
জীনটা ফের প্রশ্ন করলো- ঐ ছেলেটাকে, মানে ঐ রফিকুল ইসলাম রফিককে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
মেয়েটা একটু শরম পেলো। মাথা নীচু করে হাসি মুখে বললো- জি হুজুর, খুব।
জীনটা হাত তুলে বললো- আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালাই করুন। এবার যাও-
মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াতেই রফিক দৌড়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো এবং ঘুমিয়ে থাকার মতো চোখ বুজে রইলো। মেয়েটাও ফিরে এসে ডিমের মধ্যে ঢুকলো।
এ সব ঘটনা দেখে খুবই তাজ্জব হলো রফিক। এসব কথা শুনে খুব আনন্দও হলো তার। এসব কারণে চোখে তার ঘুম এলো না অনেক্ষণ পর্যন্ত। ঘুম এলো একদম শেষ রাতে। অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে রফিক একেবারে হতবাক।
ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছে সে দেখে, তার সেই খড়ের ঘরটা আর নেই। তার খড়ের ঘরটা দালান ঘর হয়ে গেছে। শুধুই কি দালান ঘর? রাজা-বাদশাহর দালান ঘরের চেয়েও খুব সুন্দর আর ঝকঝকে। কত রকমের রং সে ঘরে।
ঘরের বাইরে এসে রফিক যে আরো কত অবাক হলো, তা বলাই যাবে না। অবাক হয়ে সে হাত দিলো গালে। দেখলো, সেই দালান ঘরটা একতলা নয়, তিনতলা দালান। ঘাড় ভেঙ্গে দেখতে হয়। এরপর চারদিকে চোখ দিয়ে রফিক অবাকের উপর আরো অবাক হলো। দেখলো, শুধু এই একটা দালানই নয়। তার বাড়ী ভর্তি ছোট বড় আরো অনেক দালান ঘর উঠেছে। বাড়ীটা একদম রাজবাড়ী হয়ে গেছে। চারদিকে গিজ গিজ করছে দাস দাসী। সেই সাথে সে আরো দেখে, গাঁয়ের সব লোক এসে জড়ো হয়েছে তার বাড়ীর চারপাশে। তারা অবাক হয়ে দেখছে তার বাড়ীটা।
বেহুঁশ হয়ে রফিক কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তা তার খেয়াল নই। খেয়াল হলো কয়েকজন চাকরের ডাকে। কয়েকজন চাকর একটা খুবই দামী চেয়ার এনে সেখানে পেতে দিয়ে বললো- হুজুর, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন হুজুর, এই চেয়ারটায় বসুন। হায় হায়, হুজুরের পায়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণ ব্যথা ধরে গেছে।
তাদের দিকে চেয়ে রফিক বললো- তোমরা কারা?
চাকরদের মধ্যে একজনের নাম ঈশান আলী। ঈমান আলী বললো- আমরা আপনারই চাকর-নকর হুজুর। আপনারই খেদমতে আমাদের চাকুরী দেওয়া হয়েছে।
রফিক বললো- চাকুরী দেওয়া হয়েছে? কে দিয়েছে চাকুরী?
ঈমান আলী বললো- আমাদের আম্মা বেগম হুজুর। আম্মা বেগম চাকুরী দিয়েছেন আমাদের।
রফিক বললো- আম্মা বেগম! সে আবার কে?
ঈমান আলী বললো- আপনার বউ হুজুর। আপনার বিবি।
রফিকের তাজ্জব হয়ে বললো- আমার বউ!
ঈমান আলী বললো- জি হুজুর। এই প্রাসাদেই তো আছেন তিনি। খাসা হুজুর। আপনার বিবি, মানে আমাদের আম্মা বেগম খাসা দেখতে। একদম পরীর মতো।
একথা বলে একটু শরম পেলো ঈমান আলী। মাথা নীচু করে সে হাত কচলাতে লাগলো। রফিক বললো- তোমরা দেখেছো তাকে?
ঈমান আলী বললো- দেখবো না কেন হুজুর। এই তো একটু আগেই আপনার ঘরে গেলেন তিনি।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে রফিক বুঝলো, এটা তাহলে নিশ্চয়ই ঐ ডিমের মধ্যে থাকা রূপসী কন্যার কাজ। এটা বুঝতে পেরে রফিক আবার প্রশ্ন করলো- কখন দিলো চাকুরী তোমাদের?
ঈমান আলী বললো- এই তো কিছুক্ষণ আগে হুজুর। আপনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন।
রফিক আর অবাক হলো না। কত আর অবাক হবে সে। ক’দিন ধরেই তো এসব হতেই আছে হরদম। তাই আর কোন কথা না বলে রফিক চুপ হয়ে গেল।
কিন্তু এসব দেখে চুপ হয়ে রইলো না সে গাঁয়ের ঐ বদ লোকেরা। বদ লোকের মধ্যে দুইজনের বাড়ী রফিকের বাড়ীর একদম নিকটে। এদের একজনের নাম আনজাত আর অন্যজনের নাম মুনতাজ। এই আনজাত আর মুনতাজ তখনই দৌড় দিয়ে ঐ বদ নায়েবটার কাছে গেল। এই বদ নায়েবটাই তো রফিকের বাপের সব জমি কেড়ে নিয়ে আনজাত-মুনজাত এইসব বদ লোকদের দিয়েছে। নায়েবের কাছে এসে আনজাত হাঁপাতে হাঁপাতে বললো- নায়েব বাবু, নায়েব বাবু, একি অবাক কাণ্ড! এক দেশে দুই রাজা।
নায়েব প্রশ্ন করলো- দুই রাজা কেমন?
আনজাত বললো- আমাদের রাজা মশাইতো আছেই। এর উপর আবার আমাদের গায়ের ঐ রফিকটাও রাজা হয়ে গেছে। বিশাল রাজবাড়ীর মতো তার বাড়ী আর রাজরানীর চেয়ে সুন্দরী তার বউ।
শুনে নায়েব বললো- এ্যাঁ! বলো কি! রাজা হয়ে গেছে। তাহলে চলো, চলো, এখনই খবরটা আমাদের রাজা মশাইকে দিই- চলো। শুনলে রফিকের রাজা হওয়াটা বের করে দেবে রাজা মশাই।
তারা তিনজনই এবার একসাথে চলে এলো সেই এলাকার রাজার কাছে। সব কথাশুনে রাজা তো ক্ষেপে টং। বললো- কি এত বড় সাহস! আমি রাজা থাকতে আমার রাজ্যে রাজা হয় আর একজন? আমার সাথে পাল্লা দিয়ে রাজবাড়ী বানায়? এই, কে আছিস! এখনই বেঁধে আন ঐ ব্যাটা রফিককে।
সেপাইদের ডাক দিলো রাজা। সঙ্গে সঙ্গে মুনতাজ বললো- শুধু রফিককে নয় কর্তা! রফিকের বউটাকেও ধরে আনুক আপনার সেপাইরা।
রাজা বললো- কেন, ওর বউ এনে আমি কি করবো?
মুনতাজের আগেই জবাব দিলো আনতাজ। আনজাত বললো- রাণী বানাবেন রাজামশাই। ওর বউটা এতই সুন্দরী, আপনার সাতসাতটা রানীর মধ্যে কেউই এত সুন্দরী নয়।
রাজা বললো- কি করে বুঝলে?
আনজাত বললো- আপনার রানীরা তো আঁধার রাতে বাইরে এলে একটুও আলো পড়ে না কোথাও। অথচ ঐ রফিকের বউ বাইরে এলে তার রূপের আলোতে চারদিক ফর্সা হয়ে যায়। এতই ফর্সা হয়, মাটিতে একটা সুই পড়ে থাকলেও তা দেখা যায়।
রাজা বললো- বলো কি! এতই সে সুন্দরী?
আনজাত বললো- আজ্ঞে হ্যাঁ রাজা মশাই। এতটাই সে সুন্দরী।
রাজা ফের প্রশ্ন করলো- তুমি তাকে দেখেছো?
আনজাত বললো- দেখেছি মানে কি। রফিকের বাড়ীর একদম লাগালাগি আমার বাড়ী। রফিকের বউ প্রায় রাতেই ঘর থেকে বাইরে এসে কোথায় যেন যায়। ঐ বউটা ঘর থেকে বেরোলেই তার রূপের আলোতে চারদিক রোশনাই হয়ে যায়। আমার জানালাতেও ঐ রূপের আলো এসে লাগে।
রাজা একদম নেচে উঠে বললো- হ্যাঁ! এয়সা বাত। ঠিখ হ্যায়। আলবত ওকে আমি আমার আর এক রাণী বানাবো।
এই বলেই রফিক এবং রফিকের ঘরে থাকা ঐ মেয়েটাকে ধরে আনার জন্য রাজা তখনই কয়েকজন সেপাই আর এক সেনাপতি পাঠিয়ে দিলো।
সেপাইদের নিয়ে সেনাপতি রফিকের বাড়ীর কাছে আসতেই ঐ ভাংগা মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন ঐ জীনটা। দূরে থেকে তার j¤^v হাত দিয়ে জোরে একটা থাপপড় মারতেই সেপাই কয়টা ভর্তা হয়ে মাটির সাথে মিশে গেল। কি দিয়ে কি হয়ে গেল, সেনাপতিটা কিছুই বুঝতে পারলো না। সেপাইদের মাটির সাথে মিশে যেতে দেখেই সেনাপতি পেছন থেকে দিলো ভো দৌড়। এক দৌড়ে এসে রাজার সামনে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং কাঁপতে কাঁপতে বললো- বিরাট শক্তিমান লোক রাজা মশাই, ঐ রফিকটা বিরাট শক্তিমান লোক। ঐ কয়জন সেপাই দিয়ে তার কিছুই করা গেল না। সেপাইরা সব মারা গেল।
শুনে রাজা ক্ষেপে একদম আগুন হয়ে গেল। সিংহাসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কি, ব্যাটার এত বড় সাহস? আমার সেপাই মারে, ওর ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে! শয়তানটাকে নিজে আমি দেখবো।
এই বলেই, রাজা তার প্রধান সেনাপতিকে ডেকে বললো- আমি নিজে যাচ্ছি ঐ ব্যাটা রফিককে শায়েস্তা করতে। আমার সমস্ত সৈন্য নিয়ে তুমি আমার পেছনে পেছনে এসো।
রাজা তখনই সিংহাসন থেকে নেমে এলো এবং তলোয়ার খুলে নায়েব, আনজাত আর মুনতাজকে বললো- এসো, তোমরা আমার সাথে এসো। ঐ ব্যাটা রফিকের কি দশা করি আমি, তা দেখবো এসো।
ঐ তিনজনকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলো রাজা। রফিকের গাঁয়ের কাছে আসতেই ঐ গাঁয়ের সকল বদলোক খুশি হয়ে এক দৌড়ে রাজার কাছে এলো। রফিকের সৌভাগ্য দেখে সবাই হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিলো। রাজা এবার রফিকটাকে কেটে কেমন টুকরো টুকরো করে তা দেখার জন্য তারা আনন্দে নাচতে নাচতে এসে রাজার সাথে যোগ দিলো।
রাজাকে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেল রফিক। কিন্তু তাকে কিছুই করতে হলো না। ঐ বদলোকদের নিয়ে রাজা রফিকের বাড়ীর কাছে আসতেই বেরিয়ে এলো জীনটা। সে j¤^v একটা দড়ি তাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে রাজা এবং রাজার সাথের সব লোকগুলোকে খড়ির বোঝার মতো করে এক পলকে বেঁধে ফেললো। এরপর তাদের এনে একটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখলো।
এর মধ্যেই রাজার সবগুলো সৈন্য নিয়ে চলে এলো প্রধান সেনাপতি। রাজার অন্যান্য সেনাপতিও তার সাথে এলো। তা দেখে জীনটা এবার সেই দিকে এগিয়ে এলো। আকাশের দিকে হাত বাড়াতেই জীনটার হাতে চলে এলো তাল গাছের মতো মোটা আর j¤^v লোহার এক লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে দমাদ্দম কয়েকটা বাড়ি মেরে জীনটা রাজার সব সেনাপতি আর সৈন্যদের একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো। এমনভাবে মিশিয়ে দিলো যে, তাদের কারো হাড় হাড্ডিও খুঁজে পাওয়া গেলো না।
সাফ হলো সব দুশমন। রফিকের আর কোন শত্রু রইলো না। জীনটা এরপর দেশের সব লোকদের ডেকে এনে হাজির করলো সেখানে। রফিককে দেখিয়ে দিয়ে তাদের বললো- এখন থেকে তোমাদের রাজা এই রফিকুল ইসলাম। তোমরা কি এতে খুশি?
দেশের সকল লোক বিপুল আনন্দে একসাথে বললো- খুশী হুজুর, আমরা সবাই খুব খুশী। এই নতুন রাজা খুব সৎ আর ঈমানদার মানুষ এটা আমরা আগে থেকেই জানি। আগের রাজা আর তার নায়েবটা ছিল খুব বদ। আমাদের জ্বালিয়ে মেরেছে।
জীনটা বললো- বেশ, তাহলে তোমরা যাও। এ রাজা কখনোই দুঃখ দেবে না তোমাদের।
লোকজন সব চলে গেল। তামাম ঝুট ঝামেলা মিটে গেল। রফিক খুশি হয়ে জীনকে বললো, আপনি বড়ই মহৎ হুজুর। আমার জন্যে কত কি করলেন।
জীনটা হাসিমুখে বললো- না, করা আমার এখনো শেষ হয়নি। আর একটা কাজ বাঁকি আছে। আর সে কাজটা হলো তোমার শাদি, মানে বিবাহ দেওয়া।
রফিক তাজ্জব হয়ে বললো- আমার বিবাহ? কার সাথে আমার শাদি, মানে বিবাহ দেবেন হুজুর?
জীন বললো- কেন, তোমার ঘরে ডিমের মধ্যে যে মেয়ে আছে তার সাথে। সে একজন আল্লাহভক্ত, ঈমানদার আর রুপসী মেয়ে। তুমিও একজন আল্লাহভক্ত, ঈমানদার আর দর্শনধারী ছেলে। তাই ঐ মেয়েটা তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে। আমার মনে হয়, তুমিও তাকে পছন্দ করো। তাই তোমাদের শাদিটা এবার হয়ে যাওয়া উচিত।
রফিক খুশি হয়ে বললো- হুজুর আমার মনের কথাই বলে ফেলেছেন। কিন্তু হুজুর, মেয়েটা ঐ ডিমের মধ্যে এলো কি করে?
জীন বললো- সে অনেক কথা। তবে ডিমের মতো দেখতে হলেও, ওটা ডিম নয়। ওটা একটা নিরাপদ কৌটা বা বাকসো। আমিই মন্ত্র দিয়ে ঐ বাকসোটা তৈয়ার করেছি। কোন দুশমন ও বাকসো ভাংতে পারবে না। মেয়েটা যখন ইচ্ছা তখনই ঐ ডিমের মতো বাকসো থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, আবার ঐ বাক্সের মধ্যে যেতে পারবে। তবে তোমাদের শাদি হয়ে গেলে, মেয়েটার আর ঐ কৌটা মানে বাক্সের মধ্যে যাওয়ার দরকার হবে না।
রফিক বললো- তাই নাকি হুজুর! বড় তাজ্জব কথা। তা মেয়েটাকে ঐ বাক্সের মধ্যে যেতে হলো কেন, সে কথাটা একটু বলুন হুজুর। সে কথাটা শুনার আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে।
জীন বললো- শুনবে? বেশ শুনো। এটা একটা j¤^v কাহিনী। এই মেয়েটা হলো পারস্য দেশের এক মস্তবড় বাদশাহর মেয়ে। ঐ একটি মাত্র সন্তান তাদের। অনেক দোআ কালাম পড়ার পর এই মেয়েটি জন্মে। মেয়েটা দেখতে অপরূপ সুন্দরী হওয়ায় একটা দুষ্ট জীন তাকে বিয়ে করতে চায়। বাদশাহ তাতে রাজী হয় না। এতে করে ঐ দুষ্ট জীনটা বাদশাহ বেগম আর ঐ পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে। সেনা সৈন্য সব মেরে ফেলে আর বাদশাহর দালান কোটা সব ভেংগে চুরে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়। এরপর এই মেয়েটাকে ধরার জন্য ঐ দুষ্ট জীনটা তাড়া করতে থাকে। ঠিক ঐ সময় আমি সেখানে এসে হাজির হই। তখনই ঐ দুষ্ট জীনকে হত্যা করে আমি মেয়েকে রক্ষা করি।
একটু থেমে জীনটা ফের বললো- এরপরে মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। মেয়েটাকে রাখি কোথায়? বাপ-মা নেই, আত্মীয় কুটুম নেই, বাড়ী ঘরও নেই! একে কোথায় আর কার কাছে রেখে যাই? বাধ্য হয়ে অবশেষে মেয়েটাকে আমার নিজের কাছেই রেখে দিলাম। খোলামেলা রেখে দিলে আবার কোন বদ জীনের বা বদ মানুষের নজরে পড়তে পারে ভেবে, আমি ঐ ডিমের মতো বাক্সটা তৈয়ার করলাম আর ঐ বাক্সের মধ্যে মেয়েটাকে রাখলাম। এর ফলে মেয়েটার আর বিপদ থাকলো না। মেয়েটা যেমনই আল্লাহভক্ত, তেমনই সৎ ও সুন্দরী। আমি স্থীর করলাম, এই রকম একটা আল্লাহভক্ত আর সৎ ও সুন্দর ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেবো।
এই খানি বলে জীনটা থেমে গেল। অনেকক্ষণ সে আর কথা বলছে না দেখে রফিক প্রশ্ন করলো- তারপর? তারপর কি হলো হুজুর?
জীনটা ফের বললো- তারপর আমি ভেবে দেখলাম, ঐ পাহাড়ম ঘেরা মরুভূমির দেশে বদজীনের উৎপাত খুব বেশী। তাই মনে মনে ঠিক করলাম, মেয়েটাকে তোমাদের দেশে এনে আল্লাহর প্রতি ভক্তিওয়ালা একটা সৎ ছেলের সাথে শাদি দিয়ে আমি আমার দায়িত্ব শেষ করবো। এই চিন্তা করে মেয়েটাকে রাখা ঐ ডিমের মতো বাক্সোটা পকেটে তুলে নিলাম আর তোমাদের দেশের দিকে আসতে লাগলাম। এই আসতে গিয়েই বিপদ হলো আমার।
রফিক বললো- কি বিপদ হুজুর?
জীন বললো- মস্তবড় বিপদ। ঐ আসার পথে কখন যে এক আল্লাহওয়ালা দরবেশের আস্তা ভেঙ্গে ফেলেছি আমি বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলাম দরবেশ আমাকে ধরে ফেলার পরে। কিছু বলার আর সময় পেলাম না। দরবেশ সাহেব তখনই আমার পকেটে ঐ ডিমসমেত আমাকে কলসীর মধ্যে ভরে ফেললেন। এরপরে কলসীটা এনে তোমাদের এই জংগলে পুঁতে রেখে গেলেন। বলে গেলেন, আল্লাহভক্ত ঈমানদার কোন ছেলের হাতে পড়লে তবেই তুমি মুক্তি পাবে।
রফিক বললো- তারপর হুজুর?
জীন বললো- আমি বেজায় ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কতশত বছর বুঝি আমাকে এই মাটির তলে থাকতে হবে। তাই হরদম আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। এতে আল্লাহর দয়া হলো। বছর দুই না যেতেই তুমি আমাকে তুলে আনলে আর কলসীর মুখ খুলে আমাকে মুক্তি দিলে। তখনই বুঝলাম, তুমি একজন ঈমানদার ও আল্লাহভক্ত সৎ ছেলে।
জীনটা মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো। রফিক বললো- বাপারে! এযে এক তাজ্জব কাহিনী। তা মেয়েটার কোন নাম নেই হুজুর?
জীন বললো- আছে আছে। মেয়েটার বাপ-মায়ে নাম রেখেছিলেন খাতুনে জান্নাত ফজিলাতুন নেছা। মেয়েটা দেখতে ফুলের মতো সুন্দর বলে আমি ছোট করে নাম রেখেছি- ফুল বানু। ঐ অতবড় নামে না ডেকে আমি তাকে ফুল বানু বলেই ডাকি। এই ফুল বানুর সাথেই তোমাকে এখনই শাদি দিতে চাই তুমি রাজী?
মনে মনে খুব খুশি হয়ে রফিক বললো- জি হুজুর, রাজী।
জীনটা তখনই ডাক দিলো- ফুল বানু, ফুলবানু আম্মা, এখানে এসো-
ডাক শুনেই ডিমের মধ্যে থাকা ঐ মেয়েটি তখনই সেখানে এসে হাজির হলো। ইতিমধ্যে কয়েকজন মোল্লা মুসল্লী মানুষকে ডেকে আনা হয়েছিল। জীনটার অনুরোধে তারাই রফিকুল ইসলামের সাথে ফুল বানুর মাদি পড়িয়ে দিলেন।
শাদির অনুষ্ঠান ও মিষ্টি বিতরণ শেষ হলে, মুসল্লীরা চলে গেলেন। এরপর জীনটা রফিকুল ইসলাম ও ফুলবানুকে বললো- তোমরা সুখে থাকো আব্বা, সুখে থাকো আম্মা, আমি আসি। আমাকে বিদায় দাও, আমি আমার নিজের জায়গায় চলে যাই।
শুনে রফিক ভয়ে ভয়ে বললো- চলে যাবেন হুজুর? এরপর আমাদের উপর কোন দুশমনের হামলা হলে আমাদের রক্ষে করবে কে?
জীনটা বললো- ভয় নেই বাপজান। তোমরা আল্লাহ ওয়ালা ঈমাদান লোক। আল্লাহ তায়ালাই তোমাদের রক্ষে করবেন। এ ছাড়া আমি যেখানেই থাকিনে কেন সব সময় আমার নজর থাকবে তোমাদের উপর। কোন মুসিবত দেখলে তখনই আমি ছুটে আসবো তোমাদের কাছে।
রফিক বললো- আসবেন তো হুজুর?
জীনটা বললো- আলবত আসবো। কথা দিলাম তোমাদের। তাহলে আসি বাপজান! আল্লাহ হাফেজ।
রফিক ও ফুলবানু এক সাথে বললো- আল্লাহ হাফেজ।
জীনটা এবার উড়াল দিলো আকাশে
এবং আস্তে আস্তে বাতাদের সাথে মিলিয়ে গেল।
সেই দিকে চেয়ে রইলো রফিক ও
ফুলবানু। এই সময় একটি অচিনপাখী আকাশে দেখা গেল। পাখীটা গেয়ে গেল ‘বদ লোকেরা সাজা
পেলো, সৎ লোক রাজা হলো- ডিং, ডিং, ডিং।
রফিক ও
ফুলবানু এরপর পরম সুখে দিন কাটাতে লাগলো।
**********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন