সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১১

যাদুর বাঁশী

তাঁ-তাঁ রোদ। ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের এপার থেকে ওপারটা চোখেই পড়ে না। সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে পথ। পথিক দুইজন। একজন উস্তাদ, আর একজন তার সাগরিদ। উস্তাদের হাতে লাঠি, সাগরিদের পিঠে পোঁটলা। তারা পথ বেয়ে আসছে আর হাঁপাচ্ছে। পোঁটলাটা মাঝে মাঝে সাগরিদের পিঠ থেকে উস্তাদের পিঠে উঠছে, আবার উস্তাদের পিঠ থেকে সাগরিদের পিঠে যাচ্ছে। পোঁটলাটা যে খুব ভারী, তা নয়। কিন্তু পথটা j¤^v| j¤^v পথে পাঁচ সের জিনিসও বিশ সের হয়ে যায়। তার উপর এই কাঠফাটা রোদ! উস্তাদটা পণ্ডিত মানুষ। খুব বিবেচক লোক। দয়ার শরীর তার। সাগরিদটা একা কষ্ট করুক, উস্তাদ এটা চায় না। তাই পোঁটলাটা বার বার পিঠ পিঠ করছে।
অনেক কষ্টে মাঠটা পার হয়ে এলা তারা। মাঠের এপারে অনেক গাছ-গাছড়া। আছে কিছু ঘরবাড়ীও। তার আগেই পথের উপর আছে এক বিরাট পাকুর গাছ। অনেক তার ডাল পালা। মাঠ পেরিয়ে এসে সব পথিকই বিশ্রাম নেয় এই পাকুর গাছের ছায়ায়। এই উস্তাদ-সাগরিদও মাঠ পেরিয়ে এসে গাছের নীচে থামলো। পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে সাগরিদটা বসে পড়লো গাছের ছায়ায়। কিন্তু উস্তাদটা বসলো না। না বসে সে এগিয়ে এলো গাছটার একদম গোড়ার কাছে। সেখানে একটা পাথরের মূর্তি ছিল। একটা মেড়ার পাথরের মূর্তি। মেড়া মানে ভেড়া। শিং ওয়ালা পুরুষ ভেড়া। উস্তাদ এসে মেড়ার মূর্তিটার মাথায় জোরে একটা লাথি মারলো। এরপর ঘুরে দাঁড়াতেই সাগরিদটা প্রশ্ন করলো- ওটা কি উস্তাদ? কিসে লাথি মারলেন?
উস্তাদ বললো- এটা একটা মেড়া। জীবন্ত নয়, পাথরের মেড়া।
সাগরিদটা তাজ্জব হয়ে বললো, পাথরের মেড়া! সেকি! দেখি দেখি-
উঠে এলো সাগরিদ। মেড়ার কাছে এসে সে বললো- তাই তো! মেড়াই তো! পাথর কেটে বানানো এক মস্তবড় মেটা। তা এর মাথায় লাথি মারলেন কেন উস্তাদ?
উস্তাদ বললো, এই যে পাথরের গায়েই লেখা আছে লাথি মারার কথা। দ্যাখো, লেখা আছে- এই পথে যিনিই যাবেন, তিনিই দয়া করে এই মেড়ার মাথায় একটা লাথি মারবেন। লাথি মারলে ছওয়াব পাবেন। না মারলে সে ছওয়াব হারাবেন।
লেখার দিকে চেয়ে সাগরিদটা বললো- তাইতো উস্তাদ, তাইতো। কথাই তো লেখা আছে।
উস্তাদ বললো- সেই জন্যেই দ্যাখো, পথিকেরা সবাই লাথি মারার ফলে মেড়ার মাথাটা কেমন ক্ষয় গেছে কিছুটা।
সাগরিদ বললো- হ্যাঁ, তাই তো লেখা কে লিখলো উস্তাদ?
উস্তাদ বললো- মস্তবড় এক বুজুর্গ ব্যক্তি। হজ্বে যারা যান, শয়তানের উদ্দেশ্যে তাদের পাথর মারার নিয়শ মানে বিধান আছে, তা জানো তো? বুজুর্গ, মানে অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তিটা রকমই একটা বিধান রেখেছেন এখানে।
সাগরিদ বললো- সে কি! এটা কি শয়তান? মানে, এই মেড়াটা?
উস্তাদ বললো- সে তো বটেই।
সাগরিদ বললো- বলেন কি উস্তাদ! তাহলে আমিও একটা লাথি মারি?
উস্তাদ বললো- মারবেই তো। একটা কেন, তিনটাও মারতে পারো। তুমিও তো একজন পথিক আর এই পথ দিয়ে যাচ্ছো!
সাগরিদটা তখনই তিন তিনটা লাথি মারলো পাথরের মেড়াটার মাথায়। এরপর পোঁটলার কাছে ফিরে এসে উস্তাদ সাগরিদ দুইজনই গাছের ছায়ায় বসলো। বসার পরেই সাগরিদটা এবার প্রশ্ন করলো- ঘটনা কি উস্তাদ। পাথরের মেড়াটা এখানে কেন আর লাথি মারার নিয়মটাই বা কেন?
উস্তাদ বললো- এটা তো একটা তেরস্তা। তিনদিক থেকেই লোক আসত এখানে। তাই মেড়াটাকে এখানে রাখা হয়েছে যাতে করে বেশী লোক লাথি মারতে পারে।
সাগরিদ ফের প্রশ্ন করলো- সে তো বুঝলাম। কিন্তু পাথরের মেড়াটা তৈয়ার করা হয়েছে কেন, আর লাথি মারার নিয়মটা করা হয়েছে কেন? ঘটনাটা কি?
একটু থেমে উস্তাদটা প্রশ্ন করলো- ঘটনা?
সাগরিদ বললো- জি উস্তাদ। এর কারণটা কি? কি কারণে করা হয়েছে এসব?
উস্তাদ বললো- সে অনেক কথা। বলতে অনেক সময় লাগবে।
সাগরিদ বললো- তা যত সময়ই লাগুক, সবকথা আমাকে শুনাতেই হবে উস্তাদ।
উস্তাদ বললো- শুনাতেই হবে? আচ্ছা ঠিক আছে। এটা একটা মস্তবড় কাহিনী। পথ চলতে চলতে শুনাবো সব কথা।
সাগরিদটা আরো শক্ত হয়ে বসে বললো- জিনা উস্তাদ। এখনই শুনাতে হবে। কাহিনী না শুনলে আমি উঠবোই না এখান থেকে, পথ চলবো কি?
উস্তাদটা তাজ্জব হয়ে বললো- তার মানে?
সাগরিদটা গলায় জোর দিয়ে বললো- কাহিনী না শুনালে আমি এখান থেকেই ফিরে যাবো উস্তাদ। পোঁটলাটা নিয়ে আপনি একাই যান, আমি আর আপনার সাথে যাচ্ছিনে।
সাগরিদটা একদম নাছোড়বান্দা। উস্তাদ আর করে কি? বাধ্য হয়েই উস্তাদ তখন কাহিনীটা বলতে শুরু করলো :
আমির আলী আলেয়া বেগম এক সাথে পড়ে। শিশুকাল তাদের পার হয়ে গেছে। তারা এখন কিশোর কিশোরী। আলেমা বেগম সে দেশের বাদশাহর মেয়ে। সে শাহজাদা, আমির আলী কোন শাহজাদা নয়। সে সাধারণ ঘরের ছেলে। তবে তার বাপদাদারা বেশ বড়লোক আর সম্মানী মানুষ। এই জন্যেই বাদশাহর মক্তবে পড়ার সুযোগ পেয়েছে আমির আলী।
সেকালে কোন স্কুল-কলেজ ছিল না। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে সে কালের রাজাবাদশাহরা স্কুল বসাতো বাড়ীতে। মুসলশান রাজা-বাদশাহদের বাড়ীতে থাকতো মক্তব আর হিন্দু রাজা-জমিদারদের বাড়ীতে থাকতো ডোল। এইসব টোল-মক্তবে রাজা-বাদশাহ আর তাদের বড় বড় কর্মচারীদের ছেলে মেয়েরা পড়তো। সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ের সুযোগ ছিল না এখানে পড়ার। তবে রাজা-বাদশাহরা অনুমতি দিলে দুই একজন সম্মানী ঘরের ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তে আসতে পারতো। আমির আলী বাদশাহর সেই অনুমতি পেয়েই এখানে পড়তে আসতে পেরেছে।
আমির আলীর ¯^fve ছিল খুব ভাল। তার চেহারাও ছিল দেখার মতো। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশী ভাল তার চেহারা। ছাড়া, সে খুব মেধাবীও। পড়াশুনায় খুব ভাল। ওদিকে শাহজাদী আলেয়া বেগমও খুব সুন্দরী ছিল। ¯^fveI যথেষ্ট ভাল। তাই অল্প দিনের মধ্যেই আমির আলী আলেয়া বেগমের মধ্যে বেশ ভাব, মানে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

ওরা কিশোর কিশোরী বলে ওদের মধ্যে এই বন্ধুত্ব কারো নজরে তেমন পড়েনি। কিন্তু ওরা যতই বড় হতে লাগলো ওদের এই বন্ধুত্ব ততই গভীর হতে লাগলো। একজন আর একজনকে একদিন না দেখতে পেলে ওরা ছটফট করতে থাকে। এই জন্যে এটা চোখে পড়লো সবার। যা একটু কম পড়তো, বাদশাহর উজিরের ছেলে গাফফারের জন্যেই এটা আরো বেশী করে চোখে পড়লো সবার। গাফফার শাহজাদী আলেয়ার সাথে ভাব করার বারবার চেষ্টা করেও পাত্তা না পেয়ে, ঘটনাটা সবার কাছে ফাঁশ করে দিলো।
দেবেই তো। গাফফার যে আসলেই খুব খারাপ ছেলে। জব্বোর এক বদমায়েশ। উজিরের ছেলে হয়ে সে পাত্তা পায় না অথচ শাহজাদীর কাছে পাত্তা পায় একজন সাধারণ মানুষের ছেলে- গাফফার কি সহ্য করতে পারে এটা? তাই, আমির আলী আর আলেয়া বেগমের বন্ধুত্বের কথা সে সবার কাছে শুধু ফাঁশ করেই দিলো না, বাপের কাছে এসে নালিশও করলো আচ্ছা মতো।
তার বাপ উজিরটাও খারাপ মানুষ। নালিশ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহর কাছে এসে উজিরটা বললো- হুজুর, আমাদের মক্তবে আমির আলী নামের ছেলেটাকে রাখা আর ঠিক হবে না মোটেই। ওটা একটা ভয়ানক পাজী ছেলে। ওর কুনজর আমাদের শাহজাদী আলেয়ার উপর পড়েছে।
এতে রাগ হয় না কার? বিশেষ করে, রাজা-বাদশাহরা কি সহ্য করে এটা? কথা শুনে বাদশাহ ভীষণ রেগে গেলেন। প্রশ্ন করলেন- আপনি ঠিক জানেন?
উজির বললো- জি হুজুর, জি। শুধু আমি কেন, কথা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে। আমার গাফফারকে শাহজাদী কোন পাত্তাই দেয় না। শুধু আমির আলীর সাথে মাখামাখি করে।
বাদশাহ বললেন- সে কি!
উজির বললো- আপনি বলেছিলেন, হুজুর, আমার গাফফারকেই আপনি জামাই বানিয়ে নেবেন। এমন হলে তো আমার গাফফার শাহজাদীকে শাদি করতে আর রাজী হবে না হুজুর।
বাদশাহ বললেন- বলেন কি! রাজী হবে না?
উজির বললো- কি করে হবে হুজুর! একটা গেঁয়ো ছেলের সাথে শাহজাদী যদি রকম টলাটলি করে, তাহলে আমার গাফফার-
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বাদশাহ ক্রোধ ভরে বললেন, বের করে দিন। আজই আমির আলীকে আমার মক্তব থেকে বের করে দিন!
আর যায় কোথায়? উজির তো এইটেই চাইছিল। তার ছেলে গাফফার বাদশাহর জামাই হলে, এই দেশের ভবিষ্যৎ বাদশাহ হবে গাফফার। রাজ্য, রাজত্ব, ধন, দৌলত সবই তাদের হবে। এই সুযোগ নষ্ট করে দেবে কোথাকার কে এক ব্যাটা কৃষকের বাচ্চা? শাহজাদীকে বিয়ে করে বাদশাহ হবে ব্যাটা? অসম্ভব! এটা কি কখনো সইতে পারে উজির সাহেব?
বাদশাহর হুকুম পেয়ে উজির আর এক নিমেষ বিলম্ব করলো না। তখনই মক্তবে ছুটে গিয়ে আমির আলীকে মক্তব থেকে বের করে দিলো।
আমির আলীকে মক্তব থেকে বের করে দেওয়ায়, শাহজাদী আলেয়ার সে কি কান্না। আমির আলীর সাথে তখন তার বন্ধত্ব আরো গভীর হয়ে গেছে। তাই, আমির আলীকে মক্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য শাহজাদী তার আব্বার হাতে পায়ে ধরতে লাগলো। আহার নিদ্রা ছেড়ে দিলো। মেয়ের কান্না দেখে বাদশাহর মন অনেক খানি নরম হয়ে গেল। তিনি আমির আলীকে ফিরিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। তা দেখে শয়তান উজিরটা আবার বাদশাহর মন শক্ত করে দিলো। সে ব্যস্তভাবে বাদশাহকে বললো- খবরদার হুজুর, খবরদার! এতবড় ভুল কখনো করবেন না। আমির আলীকে ফিরিয়ে আনলে, এবার সে শাহজাদীকে নিয়ে একদম পালিয়ে যাবে। পালিয়ে গিয়ে শাহজাদীকে বিয়ে করবে সে। আপনার মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না।
কথায় বাদশাহ আবার শক্ত হয়ে গেলেন। মেয়ের কান্নাকাটিতে আর কান দিলেন না মোটেই। শাহজাদী আলেয়া আর করবে কি! দেখে শুনে সেও মক্তবে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। দিবেই তো। এখন মক্তবে গেলে, বেয়াদব গাফফারটা তাকে সব সময় জ্বালাতন করতে থাকবে। শয়তানের জ্বালাতন সহ্য করতে সে মক্তবে আর যাবে কেন?
শেষ হয়ে গেল শাজহাদী আলেয়ার লেখাপড়া। মক্তবের হুজুর অন্যান্য লেখাপড়ার সাথে তখন তাকে আর আমির আলীকে আরবী ভাষা দোয়া কালাম শিক্ষা দেওয়া শূরু করেছিলেন। আমির আলী খুব মনোযোগ দিয়ে নিজে সে সব শিখছিলো এবং শাহজাদীকেও মনোযোগ দিয়ে সে সব শিক্ষা করার উৎসাহ দিচ্ছিল। কিন্তু মক্তবে যাওয়া ছেড়ে দেয়ায়, শাহজাদীর পবিত্র কোরআন পাঠ দোআ কালাম- কিছু শেখা হলো না।
কিন্তু আমির আলীর সেসব শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেল না। অন্যান্য লেখাপড়ারও বন্ধ হলো না তার। মক্তব থেকে বের করে দেওয়ার সাথে সাথে আমির আলী রাজ্য ছেড়ে অনেক দূরের আর এক রাজ্যে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সে একটা মস্তবড় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। সে বিদ্যালয়ে বাংলা, অংক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান- এসব পড়ানোর সাথে পাক কোরআন হাদিস শরীফ অনেক অনেক বেশী পরিমানে শিক্ষা দেওয়া হতো। আমির আলী মেধাবী ছাত্র। তার উপর সে আবার মস্তবড় পরহেজগার, মানে নামাজ-রোজা করা, পিতামাতার ছেলে। এই বিদ্যালয়ে এসে আমির আলী তাই বাংলা, অংক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান- এসব তো ভাল করে শিখলোই, সেই সাথে কোরআন হাদিসটা এত বেশী বেশী করে শিক্ষা করলো, অল্পদিনেই সে একজন বিখ্যাত আলেম হয়ে গেল। হাফেজ হয়ে গেল পাক কোরআনের। গোটা কোরআন শরীফ তার মুখস্ত আর হাদিস শরীফের নির্দেশগুলো তার নখদর্পণে। নখদর্পণে মানে তার নখের ডগায়।
পড়াশুনা শেষ করে সে যখন দেশে ফিরে এলো, তখন সে দেশবিখ্যাত আলেম। বিজ্ঞ পণ্ডিত মানুস। কিন্তু দেশে ফিরে এসে সে দেখলো, দেশে তখন ভয়ংকর মুসিবত দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জ এলাকায় হাহাকার পড়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে জমি চাষ করা মাঠের কষক আর মাঠে গরু চরানো রাখাল প্রায় অর্ধেকটাই শেষ হয়ে গেছে। দলে দলে শেষ হয়ে গেছে পথের পথিকেরাও। তেপান্তরের কোল ঘেঁষে, অর্থাৎ ধূ ধূ মাঠের ওপারে যে বিমাল আর গভীর এক বন আছে, সেই বনে কোথা থেকে যেন কয়েক হাজার বাঘ এসে ঢুকেছে। মানুষ খেকো বাঘ। শুধুই মানুষ খায়, গরু ছাগল খায় না।
যারাই এখন মাঠে হাল বাইতে বা গরু চরাতে যাচ্ছে, তাদেরই ঘাড়ের উপর বাঘগুরো এসে ক্যাঁক করে পড়ছে আর চোখের পলকে তাদের ধরে নিয়ে বনের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বাঘগুলো জংগল থেকে আসছে আর লোকজন ধরে নিয়ে ফের জংগলে চলে যাচ্ছে, কেউ তাদের হদিস করতে পারছে না। এক নিমেষেই হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সেরেফ মাটের কৃষক-রাখালই নয়, বনের কোলঘেঁষে যে এক রাস্তা আছে মস্তবড়, সে রাস্তা দিয়েও আর কোন মানুষ এখন যাতায়াত করতে পারছে না। কেউ যেতে লাগলেই, তাদেরও বাঘগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলছে গপাগপ।
নিজের গাঁয়ে ফিরে এসে আমির আলী দেখলো, গাঁয়ের সবার মুখেই এইসব কথা আর সবার চোখেমুখে ভয়ের সে কি আতংক। পাশের গাঁগুলোতে গিয়েও সে দেখলো, সব গাঁয়েই একই অবস্থা। সবার মুখেই ঐসব কথাবার্তা আর সবাই ভয়ে জড়সড়।
দেখে শুনে অবাক হলো আমির আলী। সে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর হাদিস-কোরআন জানালোক। এতটা হয় কি করে- চিন্তা করে সে তার কোন মাথামুণ্ডু পেলো না।
শহরের কি অবস্থা- এটা জানার জন্যে আমির আলী এবার শহরে চলে এলো। শহরটা তার গাঁয়ের খুব কাছেই। বাদশাহর প্রাসাদটাও শহরে ঢোকার পথেই। শহরে এসে বাদশাহর প্রাসাদের চারপাশে শহরের সর্বত্র ঘুরে বেড়ালো সে। সেখানে এসে বাঘের উৎপাতের কথাটা কিছু কিছু শুনলো বটে, তবে যে কথাটা বেশী করে শুনলো, সেটা হলো শাহজাদী আলেয়া বেগমের কথা। সে শুনলো, শহরের লোকেরা শাহজাদীকে নিয়ে খুব বলাবলি করছে। তারা বলছে- তাজ্জব মেয়ে শাহজাদী আলেয়া বেগম। বিয়ের বয়স তার পার হয়ে যাচ্ছে, তবু বাদশাহ তাকে বিয়েতে রাজী করাতে পারছে না। বাদশাহর উজিরটাও পারছেনা। উজিরটা দিনরাত চেষ্টা করছে তার বদছেলে গাফফারের সাথে শাহজাদীর শাদি দেওয়ার। সে জন্যে কত কলকাঠি ঘুরাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শাহজাদীর মুখে এক কথা- কোন উজির-নাজির নয়, তার সাথে এককালে যে গেঁয়ো ছেলেটা তাদের মক্তবে পড়তো, ছেলেকে ছাড়া সে আর কাউকেই বিয়ে করবে না! ধন্যি মেয়ে বটে।
সেই গেঁয়ো ছেলে মানে এই আমির আলী। আমির আলী এখন অনেক বড় হয়ে গেছে বলে তাকে তারা একটুও চিনতে পারলো না। তাই অনেকে তারা তার সামনেই এসব কথা বলে গেল গড় গড় করে।
কিন্তু শহরের লোক চিনতে না পারলেও বাদশাহর লোকেরা অনেকেই চিনতে পারলো আমির আলীকে। বিশেষ করে, উজিরটা তার ছেলে গাফফারটা তাকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলো আর চমকে উঠে ভাবতে লাগলো- হায় সর্বনাশ! আপদটা আবার ফিরে এসেছে দেশে? শাহজাদী এটা টের পেলে, না জানি সে কি কাণ্ডটাই ঘটিয়ে ফেলে এই আপদটাকে নিয়ে। উজিরটা তখনই দৌড়ে গিয়ে বাদশাহকে বললো- হুজুর, বদমায়েশ আমির আলীটা আবার এসে কিন্তু আপনার প্রাসাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। এবার যদি শাহজাদীটা হারিয়ে যায়। তাহলে কিন্তু আমার গাফফারকে দোষ দিতে পারবেন না।
আমির আলীর মাথায় এখন এসব চিন্তা নেই। তার মাথায় এখন একমাত্র চিন্তা, ঘটনাটা কি। এত মানুষ খেয়ে ফেলছে বাঘে, অথচ কেউই দেখতে পাচ্ছে না সেটা, কিভাবে আর কখন বাঘগুলো জংগল থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের ঘাড়ে পড়ছে- একজনও তা জানে না, ব্যাপার কি?
ঘরে বসে দুই চার দিন সব চিন্তা করার পর আমির আলী বুঝে দেখলো, না, ঘরে বসে থেকে কোন কুলকিনারা করা যাবে না এর। ঘটনাটা দেখতে হবে ঘটনার স্থানে গিয়ে। সেখানে গেলে ঘটনাটা বুঝা যাবে কিছুটা। এত লোক বাঘে খেয়ে থাকলে, অবশ্যই মানুষের হাড়হাড্ডি পাওয়া যাবে ঘটনাস্থলে। জংগলের ভেতরে তো বটেই, ঘটনাস্থলে গেলে, জংগলের বাইরেও অনেক হাড়হাড্ডি দেখা যাবে নিশ্চয়ই। সেই সাথে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে বসে থাকলে, কখন বেরিয়ে আসে বাঘগুলো তাও দেখা যাবে।
আমির আলী  খুব সাহসী ছেলে। সঙ্গে যাওয়ার জন্যে কাউকেই না পেয়ে সে একাই বেরিয়ে পড়লো শক্ত একটা বল্লম হাতে নিয়ে।
ধূ ধূ মাঠটা পেরিয়ে সে চলে এলো মাটের কোল ঘেঁষে থাকা সেই বন বা জংগলটার কাছে। জংগলের কাছে এসে সে তাজ্জব হয়ে দেখলো- জংগলের বাইরে কোথাও মানুষের হাড়হাড্ডির কোন wP‎‎ýI নেই। জংগলটা মাঠটার যতখানি এলাকা ঘেঁষে ছিল, আমির আলী জংগলের বাইরের সেই এলাকাটা আগাগোড়া ঘুরে ঘুরে দেখলো। দেখলো, কোথাও কোন হাড়হাড্ডি নেই। জংগলের বাইরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও কোন হাড়হাড্ডি না দেখে সে এবার স্থির করলো, যা থাকে নসীবে, জংগলের খানিকটা ভেতরে গিয়েও সে দেখবে- কোন হাড়-হাড্ডি আছে কিনা।
যেই চিন্তা সেই কাজ। পাক কোরআনের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সূরা মনে মনে পড়ে নিয়ে এবং বল্লমটা বাগিয়ে ধরে সে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়লো বনের মধ্যে। কিন্তু বনের ভেতরে ঢুকে পড়েও আমির আলী হতাশ হলো। জংগলের মধ্যে কোলেও কোন হাড়গোড় নেই। অবাক হয়ে সে আস্তে আস্তে বনটার, মানে জংগলটার অনেক গভীরে চলে গেল। অনেক বেশী ভেতরে গিয়েও সে মানুষের কোন হাড় বা মাথার খুলি কোন কিছুই দেখতে পেলো না সেখানে। ছাড়া কথা আছে আরো। কয়েক হাজার বাঘ এসে এই জংগলে ঢুকে থাকলে, এতক্ষণ দুই একটা বাঘের সন্ধান পাওয়া যেতোই জংগলের এত ভেতরে এসে। কিন্তু কোন বাঘের সন্ধানও সে পেলো না।
এতে করে আমির আলীর দৃঢ় ধারণা হলো- বাঘে খাওয়ার কোন ঘটনাই নয় এটা। এত মানুষ বাঘে খেলে, তাদের কিছু না কিছু হাড় হাড্ডি পাওয়া যেতোই কোথাও না কোথাও। কোন হাড়-হাড্ডিই নেই যখন আর একটা বাঘও যখন দেখা গেল না কোথাও, তখন নিশ্চয়ই এটা বাঘে খাওয়ার ব্যাপার নয়। এর পেছনে অন্য কোন রহস্য আছে।
এই অন্য রহস্যটা কি- কথা ভাবতে ভাবতে আমির আলী বেরিয়ে এলো অরণ্যের গভীর থেকে। খোলা মাঠের একদম কাছাকাছি এসে সে বসে পড়লো হালকা পাতলা গাছ গাছড়ার মধ্যে। জায়গাটা পরিস্কার ছিল এবং মাথার উপর গাছের ছায়া ছিল। ছাড়া, ঘুরে ঘুরে সে ক্লান্ত হয়েও গিয়েছিল। সবার উপর কথা, রহস্যটার, মানে ঘটনাটার কোনই কুলকিনারা না করে ফিরে যেতে তার মনও চাইলো না। একারণেই সে বসে পড়লো চুপ করে এবং বসে বসে ভাবতে লাগলো- তাহলে কিসে কি হচ্ছে? মাঠের এত কৃষকদের আর রাখাল বালকদের কিসে ধরে খাচ্ছে বা কোথায় তারা যাচ্ছে- এটা টের করা যায় কি করে?
কতক্ষণ সে নীরবে বসে ভাবছিল, তা তার খেয়াল নেই। খেয়াল হলো হঠাৎ এক বাঁশীর তীব্র অথচ মধুর আওয়াজে। বাঁশীর সুরটা এতই মধুর ছিল, যার কানেই এই সুরটা গিয়ে পৌঁছলো, সে-ই দৌড় ঝাপ করে ছুটে এলো এই বাঁশী শোনার জন্য। এক এক করে অনেক লোক জুটে গেল বাঁশীওয়ালার সামনে। আমির আলীকে ছুটে যেতে হলো না। কারণ, বাঁশীটা বেজে উঠলো তার একদম কাছেই মস্তবড় এক পাকুর গাছের নীচে।
আমির আলী দেখলো, বাশীওয়ালী দেশী লোক নয়। সে একজন বিদেশী লোক। চীন দেশের লোকই হবে সে। সেই রকমই চেহারা। তা যে দেশেরই হোক, তার বাঁশীর সুরটা জগৎ ভুলানো সুর। দুনিয়াদারী ভুল করে দেওয়ার মতো সুর। বাঁশীওয়ালা পাকুর গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে থেকে বাজাতে লাগলো। আর প্রচুর লোক তার সামনে বসে থেকে মোহিত হয়ে শুনতে লাগলো সেই বাঁশীর সুর। মোহিত হয়ে শুনতে লাগলো আমির আলীও।

শুনতে শুনতে আমির আলীর মনে হলো, তার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে এবং ঘুম আসছে তার চোখে। সে লক্ষ্য করে দেখলো, বসে থাকা লোকদের সকলেরই একই অবস্থা হচ্ছে।
এর পরেই বাঁশীওয়ালা বাঁশীতে ভোঁ ভোঁ ভোঁ করে তিনটে বিকট শব্দ করার পরে উল্‌টা ধরনের এমন একটা সুর বাজাতে লাগলো যে, সে সুর কানে যাওয়ার সাথে সাথে আমির আলী লক্ষ্য করলো, তার হাতে পায়ে ভেড়ার লোম গজিয়ে যাচ্ছে এবং হাত-পাগুলো ভেড়ার পা হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চেয়ে দেখলো, অন্যান্য সকলেরই হাতে পায়ে ভেড়ার লোম গজিয়ে যাচ্ছে এবং সবার হাত-পাই ভেড়া পা হয়ে যাচ্ছে।
আমির আলীর বুঝতে আর মোটেই অসুবিধে হলো না, লোকটা একটা যাদুকর আর তার বাঁশীটা একটা যাদুর বাঁশী। ভেড়ার মতো লোম গজানো আর ভেড়ার পায়ের মতো হাত-পা হয়ে যাওয়া এগুলো সবকিছুই যাদুর জন্য হচ্ছে। সেই সাথেই আমির আলীর খেয়াল হলো, আল্লাহ তাআলার বাণীর কাছে, অর্থাৎ পাক কোরআনের আয়াতের কাছে কোন যাদুটোনাই টিকে না। চোখের পলকে সব যাদুই অকেজো হয়ে যায়।
আমির আলী তাই তৎক্ষণাৎ মনে মনে পাক কোরআনের কিছু বিশেষ বিশেষ সূরা দ্রুত পড়ে যেতে লাগলো। হ্যাঁ, যে কথা সেই কাজ। সুরা পড়া শুরু করার সাথে সাথে আমির আলী দেখলো, তার হাত-পা থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে ভেড়ার লোম আর তার হাত পা ভেড়ার পা না হয়ে ফের মানুষের মানে তার নিজের পা হয়ে যাচ্ছে। চোখের নিমেষেই যাদুকরের যাদু আমির আলীর কাছে অকেজো হয়ে গেল। আমির আলী যেমন ছিল তেমনই রইলো। কিন্তু সে দেখলো, বাঁশীওয়ালার সামনে বসে থাকা লোকগুলো সবাই ইতিমদ্যেই পুরোপুরি ভেড়া হয়ে গেছে। তাদের একজনও আর মানুষ নেই। আমির আলী বুঝতে পারলো, পবিত্র কোরআনের আয়াত মানে কোন সূরা জানা না থাকায় এই দশা হলো ওদের।
দেখে তাজ্জব হলো আমির আলী। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তাজ্জব হতে আরো অনেক বাকী ছিল তার। মানুষগুলো ভেড়া হয়ে যাওয়ার পরে যাদুকর তার বাঁশী বাজানো বন্ধ করলো। এরপর সে বাঁশী হাতে জংগলের মধ্যে যেতে লাগেলা। অমনি আর এক কাণ্ড দেখে আমির আলী অবাক। দেখলো, ভেড়াগুলো লাফ দিয়ে উঠে  পরিমরি ছুটতে লাগলো বাঁশীওয়ালার পেছনে পেছনে। ছুটে কে কার আগে বাঁশীওয়ালার কাছে যাবে ভেড়াগুলোর মধ্যে এমনই এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। এমন প্রতিযোগিতা যে মাথায় লাঠি মারলেও ওদের আর পেছনে ফেরানোর উপায় নেই। আমির আলী নিশ্চিত হলো, এদের অন্তরে দোআ কালামের কোন ছাপ না থাকাই এর কারণ। যাদু চেপে বসেছে ওদের উপর।
উঠে দাঁড়ালো আমির আলিওভেড়াগুলো নিয়ে যাদুকর কোথায় যায়- তা দেখার জন্য আমির আলী পিছু নিলো তাদেরঅনেক খানি দূরে দূরে থেকে এবং দোআ কালাম পড়তে পড়তে আমির আলী খুব সাবধানে ভেড়াগুলোর পেছনে পেছনে চলতে লাগলো
জংগলের মধ্যে এসে যাদুকর ও ভেড়ার পাল চলছে তো চলছেইকোথাও থামে নাজংগলের অনেক অনেক ভেতরে এসে এক সুড়ঙ্গের মুখে অবশেষে থামলোসুড়ঙ্গের মুখে ছিল এক লোহার কপাটযাদুকর তার যাদুর বাঁশী দিয়ে সেই কপাটে ঠুকঠুক করে তিনটে বাড়ী দিতেই খুলে গেল কপাট আর এক মস্তবড় গর্ত বেরিয়ে পড়লোসঙ্গে সঙ্গে যাদুকর ও ভেড়াগুলো ঐ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেলভেড়াগুলো ঢোকার পর যাদুকর এসে আবার ঐ লোহার কপাটে বাঁশী দিয়ে ঠুক ঠুক করে তিনটে বাড়ি দিলোআর সঙ্গে সঙ্গে কপাট আবার বন্ধ হয়ে গেলশুধু কপাটই বন্ধ হলো না, সেই সাথে সেই সুড়ঙ্গের মুখটাও বুঁজে গেলএমনভাবে বুজে গেল যে সেখানে কোন সুড়ঙ্গ আছে সেটা আর বোঝার উপায় রইলো নাভেতর থেকে কপাটে টুকটুক করে বাড়ি দেওয়া আমির আলী দেখতে না পেলেও ঐ টুক টুক আওয়াজ শুনেই সে বুঝতে পারলো, বাঁশীওয়ালা আবার বাঁশী দিয়ে বাড়ি দিলো কপাটে
আমির আলী এখন আর করে কি? জংগলের মধ্যে একা একাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আবার ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো জংগল থেকেজংগল থেকে বেরিয়ে আমির আলী এবার সাসরি বাড়িতে চলে এলোনা এসেই বা করবে কি? ওখানে তো আর তার করার কিছু ছিল নাবাঘে খাওয়া রহস্যটা যে সে ফাঁশ করতে পেরেছে এই তো যথেষ্টকিন্তু বাড়ীতে এসে একথা সে কাউকেই বললো নাকারণ, মানুষগুলোকে যে বাঘে ধরে খাচ্ছে না, একটা যাদকুর যে তাদের ভেড়া বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এ কথা বললে তো কেউ বিশ্বাস করবে নাসে ছাড়া এটা তো আর কেউ দেখেনিএকথা বললে বরং তাকেই সবাই পাগল বলবেবাড়ী এসে তাই সে চুপ করে রইলো
কিন্তু চুপ করে বেশীক্ষণ থাকতে পারলো না আমির আলীএরপরেই তার ভাবনা হলো- এতগুলো মানুষ ভেড়া হয়ে মাটির তলে চলে গেল, এদের উদ্ধার করার উপায় কি?
ঘরে বসে না ভেবে আমির আলী তাই আবার প্রতিদিন ঐ পাকুর তলায় আসে আর লুকিয়ে বসে থেকে প্রতিদিনই অনেক লোককে ভেড়া হতে দেখেপাকুর তলা আসার সময় সে মাঠের মধ্যে যাকেই পায় তাকেই বাঁশী শুনতে না আসার জন্যে বার বার করে বলে আসেকিন্তু কে শুনে কার কথা! যেই বাঁশী বেজে উঠে অমনি সব লোক পাগলা হয়ে ছুটে আসে আর ভেড়া হয়ে যায়কোরআন শরীফের আয়াত পড়ার জন্যে আমির তা হয় নাকাজেই, শুধু দেখা ছাড়া আমির আলী আর করবে কি? প্রত্যেক দিন বসে থেকে সে এইসবই দেখে শুধু
এইসব দেখতে দেখতে একদিন সে আর এক কাণ্ড দেখতে পেলোদেখলো, যাদুকরটার গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস আছেমানুষগুলোকে ভেড়া বানোর পরে যাদকুর সেদিন তখনই উঠে গেল নাপকেট থেকে গাঁজার কলকে বের করে যাদকুর বসে বসে কলকেতে গাঁজা ভরতে লাগলোসামনেই সে অনেকগুলো শুকনো খড়ি জ্বালিয়ে রেখেছিলগাঁজা ভরার পর এবার সে সেখান থেকে কলকেতে আগুন তুলি নিলোব্যাস! ভেড়াগুলো বসে রইলো সামনেযাদকুর এবার ধুমছে গাঁজার কলকে চুষতে লাগলো

কলকে টানতে টানতে গাজার নেশায় যাদুকর কিছুটা বেহুঁশ হয়ে গেলবাঁশীটা সে তার পায়ের কাছে রেখে ছিলএক সময় পায়ের ঠেলা লেগে বাঁশীটা গড়তে গড়তে গিয়ে ঐ জ্বালিয়ে রাখা আগুনে ঠেকলো আর বাঁশীতে আগুন ধরে গেল
সঙ্গে সঙ্গে তাজ্জবের উপর তাজ্জব কাণ্ডআমির আলী দেখলো, বাঁশীতে আগুন ধরার সাথে সাথে ভেড়াগুলোর পা আবার মানুষের হাত পা হয়ে যেতে লাগলো আর যাদুকরের হাতে পায়ে গজাতে লাগলো ভেড়ার লোম এবং যাদকুরের হাত-পা ভেড়ার পা হয়ে যেতে লাগলো
এতে করে চমকে উঠলো যাদুকরছুটে গেল তার নেশাসঙ্গে সঙ্গে সে আগুন থেকে বাঁশীটা তুলে নিয়ে বাঁশীর আগুন নিভিয়ে ফেললোবাশীটার পেছনের দিকে অল্প একটু আগুন লেগেছিল বলে রক্ষে পেলো যাদুকরবাঁশীটা পুড়ে গেলে কম্ম তার কাবার হয়ে যেতো
যা হোক, বাঁশীর আগুন নিভিয়েই যাদুকর আবার ফুঁ দিলো বাঁশীতেবাজাতে লাগলোতার সেই যাদুর সুরসঙ্গে সঙ্গে ভেড়াগুলোর পা আবার ভেড়ার পা হয়ে গেল এবং যাদকরের হাত পা থেকে মিলিয়ে গেল ভেড়ার লোমঅর্থাৎ যাদকুরের হাত পা ভেড়ার পা না হয়ে আবার মানুষের হাত পা হয়ে গেলযাদকুর আর দাঁড়ালো না সেখানেবাশী হাতে নিয়ে সে তখনই জংগলের মধ্যে চলে গেলভেড়াগুলোও ছুটে গেল তার পেছনে পেছনে
এবার আমির আলীর আনন্দ দেখে কে? ইউরেকা- ইউরেকা অর্থাৎ পেয়েছি- পেয়েছি, মানুষগুলোকে উদ্ধার করার আর যাদুকরকে জব্দ করার পথ এবার পেয়েছিবলে মনে মনে সে চিৎকার করে উঠলোসে বুঝতে পারলো, যাদুকরের ঐ যাদুর বাঁশীই সববাঁশী হাতে না থাকলে, ঐ ছাগলগুলোও যে তার পেছনে যায় নাএটাও আমির আলী লক্ষ করেছে এর আগেযাদুকরের সব শক্তি ঐ বাঁশীর মধ্যেসুতরাং ঐ বাঁশীটা হাত করতে পারলেই ব্যসকেল্লাফতেঐ বাঁশীতে আগুন দিলেই ভেড়াগুলো সব মানুষ হবেআর যাদুকরটাও খুব সম্ভব ভেড়া হয়ে যাবে
আনন্দে দুলতে দুলতে বাড়ীতে ফিরে এলো আমির আলীবাড়িতে বসে বসে ভাবতে লাগলো, কি করে ঐ যাদুর বাঁশীটা হাত করা যায়জোর করে কেড়ে নিতে গেলে অন্য কোন বিপদ ঘটে যদিহাজার হোক, যাদকুর তোআরো কতরকম ফন্দি ফিকির তার জানা আছে, কে জানেবাড়ীতে বসে বসেই সে এসব কথা ভাবতে লাগলোকয়েকদিন সে আর ঐ পাকরতলায় গেল না
কিন্তু এরই মধ্যে সৃষ্টি হলো আর এক ঝামেলাএকদিন বাদশাহর পাইক, মানে এক সৈন্য এসে আমির আলীর বাড়িতে হাজিরপাইকটা আমির আলীকে বললো, তুমি শাহজাদী আলেয়া বেগমকে চুরি করে এনেছোতাই বাদশাহ তোমাকে এখনই ধরে নিয়ে যেতে বলেছেন
শুনে আমির আলী তো তাজ্জববললো, আমি শাহজাদীকে চুরি করে এনেছি মানে? কে বললে সে কথা?
পাইক বললো- বাদশাহর উজির আর তার ছেলে গাফফার এই কথা বলেছে
আমির আলী বললো, সেকি! আমি কোথা থেকে চুরি করে আনলাম শাহজাদীকে?
পাইক বললো, রাস্তা থেকেপালকীতে চড়ে শাহজাদী আত্মীয়ের বাড়ীতে যাচ্ছিললোকজন নিয়ে গিয়ে তুমি পালকীসমেত শাহজাদীকে চুরি করে তোমার বাড়ীতে এনেছোউজির আর তার ছেলে এটা দেখেছেশাহজাদী আর পালকী তোমার বাড়ীতেই আছেসারাদেশ তন্নতন্ন করে খুঁজে শাহজাদী আর আর পালকী কোথাও পাওয়া যায়নিতুমিই তোমার বাড়ীতে লুকিয়ে রেখেছো
আমির আলী বললো- মিথ্যা কথাতুমি আমার বাড়ীর সব জায়ঘা খুঁজে দেখোশাহজাদী আর তার পালকী যদি কোথাও পাও, আমাকে ধরে নিয়ে যাওযদি না পাও, তাহলে বাদশাহকে গিয়ে বললো, এ কাজ ঐ উজির আর তার ছেলেই করেছে
আমির আলীর বাড়ীটা আগাগোড়া খুঁজে দেখে শাহজাদী বা তার পালকী কিছুই পেলো না পাইকটাতাই বাধ্য হয়ে সে ফিরে গেল
ফিরে তো তাকে যেতেই হবেআমির আলী তো শাহজাদীকে চুরি করতে যায় নিশাহজাদীকে চুরি করতে গিয়েছিল ঐ শয়তান গাফফারটাইআমির আলী আবার দেশে ফিরে আসায় গাফফারের সাথে শাহজাদীর আর বিয়ের সম্ভাবনা নেই দেখে শাহজাদীকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার যুক্তি গাফফারের বাপই গাফফারকে দিয়েছিলগাফফারকে সে বলেছিল, আগামীকাল শাহজাদী পালকীতে চড়ে কুটুমবাড়ীতে যাচ্ছেলোকজনসহ গিয়ে তুমি পালকী সমেত শাহজাদীকে জোর করে জামনগর নিয়ে যাওজামনগরের রাজা আমার বন্ধুতাকে আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছিজামনগর গেলেই জামনগরের রাজা শাহজাদীর সাথে তোমার শাদি বিয়ে দেবেতখন দেখবো কোথায় থাকে শাহজাদীর দেমাগ! কেমন করে সে শাদি করে ঐ আমির আলীকে
লোকজন নিয়ে গাফফার সেই যে বেরিয়ে গেল, তারপর থেকে শাহজাদীর আর কোন খবর নেইগাফফার ফিরে এসেছে কিন্তু শাহজাদী আর তার পালকীটা লাপাত্তাআমির আলীর বাড়ীতে খুঁজলে ওসব পাওয়া যাবে কেন?
পাইকটা চলে যাওয়ার পর আমির আলী ভাবতে লাগলো, এতো আচ্ছা এক ফ্যাসাদ হলো দেখছিউজিরের কথা বিশ্বাস করে বাদশাহ যদি তাকে ধরে নিয়ে যায়, তাহলে তো যাদুকরের হাত থেকে ঐ মানুষগুলোকে আর উদ্ধার করা যাবে নাতাই সে স্থির করলো, মরণ হয় হোক, ঐ ভেড়াগুলোর সাথে সেও যাবে ঐ যাদকুরের গর্তের মধ্যেবিনা দোষে বাদশাহর হাতে মরার চেয়ে ঐ অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে গিয়ে মরা অনেক ছওয়াবের কাজযাদুকরের গর্তের মধ্যে গিয়ে একবার সে শেষ চেষ্টা করে দেখবে, ভেড়া হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে বাঁচানো যায় কিনা
সেই দিনই ভেড়ার একটা লোমওয়ালা আস্ত চামড়া যোগাড় করলো আমির আলী এবং ঐ চামড়া হাতে চলে গেল ঐ পাকুরতলায়
এবার পাকুরতলায় এসেই তার চক্ষু স্থিরসে অবাক হয়ে দেখলো, শাহজাদীর পালকীটা সেখানে এক পাশে পড়ে আছেএটা যে বাদশাহর বাড়ীর পালকীআমির আলী তা দেখেই চিনতে পারলোকিন্তু পালকীতে শাহজাদীও নেইপালকীর বেয়ারাগুলোও নেইপালকীটা এখানে কি করে এলো, আমির আলী চিন্তা করে তার কুল করতে পারলো নাতবে সে বুঝতে পারলো, শাহজাদীও ভেড়া হয়ে ঐ গর্তের মধ্যে গেছেসে কয়েক দিন এখানে আসেনিএরই মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছে
আমির আলীকে আর বাধে কে? এমনিতেই যাদুকরের গর্তের মধ্যে যাওয়ার জন্য আমির আলী এখানে এসেছিলশাহজাদী ও আলেয়াও ভেড়া হয়ে আটকা পড়েছে ঐ গর্তে এটা বুঝতে পেরে আমির আলীর সে আগ্রহ আরো শতগুণে বেড় গেলতার পেয়ারের শাহজাদী আটকা পড়ে মারা যাবে আর তার উদ্ধারে আমির আলী না গিয়ে কি আর পারে?
তাই সে ঝোপের আড়ালে চুপ করে বসে রইলোযাদুকর সেদিন মানুসগুলোকে ভেড়া বানিয়ে নিয়ে যেতে লাগলে, ভেড়ার চামড়াটা গায়ে জড়িয়ে আমির আলীও ভেড়ার দলের সাথে মিশে গেল এবং তাদের সাথে যাদুকরের ঐ গর্তের মধ্যে চলে এলোযাদুকর এটা বুঝতেই পারলো না
গর্তের মধ্যে এসে আমির আলি দেখে, সেখানে এলাহী কারবারগর্তটার পরেই মাটির তলে বিশার এক পাকা গুদাম ঘরসেই গুদামঘর ভেড়ার পালে ভর্তিগুদাম ঘরের পরেই একটা অফিস ঘর আর সেই অফিস ঘরের পেছনেই আর এক সুড়ঙ্গ পথঅন্য এক সময় আমির আলী ঐ সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে দেখলো, সেই পথটা চলে গেছে সমুদ্রের ধারেএবং গোপন এক জাহাজ ঘাটেসমুদ্রটা অবশ্য জংগলের নিকটেই ছিলআমির আলী বুঝলো, এই জাহাজঘাট দিয়ে তাহলে ভেড়াগুলো বিদেশে চালান দেওয়া হয়
থাক সে কথামাটির তলে এসেই ঐ গুদাম ঘরে গেল এবং ভেড়াদের মাঝে খুঁজতে লাগলো, সেখানে শাহজাদী ভেড়া হয়ে আছে কিনাথাকলে তো তাকে চিনতে পারবে শাহজাদী আর ছুটে আসবে তার কাছে
হলোও ঠিক তাইআমির আলী অল্প একটু খুঁজতেই, একটা ভেড়া ছুটে এলো তার কাছে এবং তার, মানে আমির আলীর হাত-পা শুঁকতে ও চাটতে লাগলোতা দেখে আমির আলী তার কানে কানে বললো- তুমি কি শাহজাদী?

সঙ্গে সঙ্গে ভেড়াটা মাথা দোলালো জোরে জোরেগুদাম ঘরটা পাকা হলেও মেঝে ছিল মাটিরধূলা ছিল, প্রচুরতখনই ভেড়াটা পা দিয়ে মেঝেতে লিখলো- হ্যাঁ আমি শাহজাদী আলেয়া
তা দেখে আমির আলী চমকে উঠে বললো- কি কাণ্ড! কি কাণ্ড! তুমি এখানে? তুমি কি কথা বলতে পারো না
শাহজাদী আবার পা দিয়ে লিখলো- আমি কথা বলতে পারিনেতবে সব কথা শুনতে পাই, বুঝতে পারি
আমির আলী বললো- তা তুমি এখানে, মানে এই পাকুর তলায় এলে কি করে?
শাহজাদী লিখলো- গাফফারের হামলা থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্যে আমার পালকীর বাহকেরা পালকী নিয়ে এখানে পালিয়ে আসেএতে করে আবার আমরা সবাই এই যাদুকরের যাদুর খপপরে পড়ে গেছি
আমির আলী বললো- কি তাজ্জব! আল্লাহর বাণী, মানে কোন দোআ কালাম না শেখার জন্যেই তোমার এই অবস্থা হয়েছেআল্লাহর বাণীর কাছে কোন যাদু টোনা দাঁড়াতে পারে না বুঝেছো! এই যে আমাকে দেখো, আমি কোরআন শরীফের আয়াত পড়তে আর বলতে শিখেছি বলেই যাদুকরের যাদু আমাকে ভেড়া বানাতে পারেনি
এই সময় যাদুকরকে এই দিকে আসতে দেখে আমির আলী ও শাহজাদী দুইজন দুই দিকে সরে গেল
যাদুকর এসে গুদামে ঢুকালোতার সাথে গুদামে এলো আর এক বিদেশী লোকতার কথাবার্তা শুনে আমির আলী বুঝতে পারলো, এই লোকই ভেড়ার বেপারীভেড়াগুলো বেচার জন্যে জাহাজ ভর্তি করে ভেড়া নিয়ে এই লোকই বিদেশে যায়
গুদাম ঘরে এসে ঐ বিদেশী লোকটা যাদুকরকে জিজ্ঞাসা করলো- তোমার গুদামে এখন মোট কতটা ভেড়া আছে?
যাদুকর বললো- তা হাজার দশেক হবে
বিদেশী লোকটা খুশী হতে পারলো নাবললো মাত্র হাজার দশেক? ভাগ্যে, আমি আগেই জাহাজ নিয়ে আসিনিতাহলে আমার জাহাজ ভাড়াই পোষাতো না
যাদুকর বললো- কি রকম, কি রকম?
বিদেশীটা বললো- কমছে কম বিশ হাজার ভেড়া ছাড়া জাহাজ ভরে নাদশ হাজার ভেড়া নেয়ার জন্যে জাহাজ আনলে কি জাহাজ ভাড়া পোষাতো? ভেড়া প্রতি ডবল খরচ পড়তোএকটা নিই, দশটা নিই, জাহারে ভাড়াটা তো পুরোটাই দিতে হবে আমাকে
যাদুকর বললো- তা ঠিক, তা ঠিক
বেপারীটা বললো- তোমার ভেড়াগুলো খুব বড় আকারের আর মানুষ ভেড়ার গোস্তটা খেতেও খুব my¯^v`y, তাই তোমার এই ভেড়ার প্রচুর চাহিদা আছে দেশেএ কারণেই তুমি কতটি ভেড়া যোগাড় করেছো- সেই খবর নিতে এলাম
যাদুকর বললো- বেশ করেছেনএখন তাহলে ফিরে যানএকমাস পরে একেবারে জাহাজ নিয়ে চলে আসুনদশ হাজার ভেড়া তো আছেইআর দশ হাজার মানুষকে একমাসে আমি অনায়াসেই ভেড়া বানিয়ে ফেলতে পারবো
কথা বলতে বলতে গুদামঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঐ যাদুকর আর ঐ ভেড়ার বেপারীযাদুকরের কথাশুনে আমির আলীর ভীষণ রাগ হলোসে মনে মনে বললো- দাঁড়া ব্যাটা শয়তান! আর একটা মানুষকেও ভেড়া বানানোর সুযোগ তোমাকে দেবো নাআজই তোমার বাঁশীটা আমি হাত করবো
করলোও ঠিক তাইবাঁশী চুরি করার কেন সাধ্য ভেড়াগুলোর না থাকায় যাদুকর বাঁশীটা যেখানে সেখানে রেখেই ঘুমিয়ে পড়তোআজও তাই করলোসে তো আর জানে না যে ভেড়ার মধ্যে মানুষ ঢুকে পড়েছেতাই বাঁশীটা তার বিছানা থেকে অনেক খানি দূরৈ একটা টুলের উপর রেখে বিভোর হয়ে ঘুমুতে লাগলো যাদুকর
এই সুযোগে চুপি চুটি তার ঘরে ঢুকলো আমির আলীআস্তে আস্তে বাঁশীটা তুলে নিয়েই ফের চুপি চুপি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে
আর তাকে পায় কে? গুদামঘর ও অন্যান্য ঘরগুলো মাটির তলে হওয়ায় প্রত্যেক স্থানেই মশাল জ্বালানো ছিলমশালের আলোতেই অন্ধকার দূর করা হতোবাঁশীটা হাত করার পরেই একটা তেল ভর্তি বড় মশাল হাতে নিয়ে আমির আলী ছুটে এলো ঐ গর্তের মানে সুড়ঙেগর দুয়ারের কাছেঘটনা ঐ একটাইবাশী যার হাতে থাকে ভেড়াগুলোও ছুটে আসে তার পেছনেএবারো তাই এলোআমির আলী বাঁশী হাতে দুয়ারের কাছে আসতেই গুদামের সব ভেড়া হুড়মুড়-দুড়মুড় তার পেছনে পেছনে ছুটে এলো দুয়ারের কাছেএরপর আমির আলী বাঁশী দিয়ে দুয়ারের কপাটে ঠুক ঠুক করে তিনটে বাড়ি দিতেই খুলে গেল কপাট
আর কি! সঙ্গে সঙ্গে আমির আলী ও ভেড়াগুলো বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গের বাইরে এবং ছুটতে ছুটতে চলে এলো জঙ্গলের বাইরে ঐ খোলামাঠেআগে আগে আমির আলী বাঁশী ও মশাল হাতে ছুটছেতার পিছে পিছে ছুটছে ভেড়া হয়ে যাওয়া শাহজাদী ও অন্যান্য ভেড়াগুলোআমির আলীর তখন সেকি আনন্দ
কিন্তু যাদুকর ঐভাবে ঘুমিয়েই রইলো নাভেড়াগুলো বেরিয়ে আসার হুটপাটে ঘুম ভেঙ্গে গেল তারঘুম ভেঙ্গে যেতেই সে দেখে, ঘরে তার বাঁশীটাও নেই, গুদামে ভেড়াগুলোও নেইচমকে উঠে সেও ছুটে এলো সুড়ঙ্গের ও জংগলের বাইরে এবং ছুটতে লাগলো আমর আলী ও ভেড়াগুলোর পেছনে পেছনে

বাঁশীটা কেড়ে নেয়ার জন্য যাদুকর মারিয়া হয়ে আমির আলীর কাছে আসার চেস্টা করতে লাগলোযাদুকর কাছে আসতেই আমির আলী বাশীটা মশালের কাছে এনে বলতে লাগলো- খবরদার! কাছে আসার চেষ্টা করলে এই বাঁশীতে আগুন ধরিয়ে দেবো
শুনেই যাদুকর অমনি চমকে উঠে দূরে সরে যেতে লাগলোকারণ সে জানে- বাঁশীতে আগুন দিলেই তার জারিজুরি সব শেষবাশীটা পুড়ে গেলে নিজে ভেড়া হয়ে যাবে আর ভেড়াগুলো সব মানুষ হয়ে যাবেতাই দূরে দূরে থেকে সে আমির আলীর পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলো এবং বাঁশীটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে আমির আলীকে করুণ কণ্ঠে অনুরোধ জানাতে লাগলো
তার অনুরোধে কান না দিয়ে আমির আলী একটানা ছুটতে লাগলো দেশের বাদশাহর বাড়ীর দিকেবাদশাহর কাছে যাবে সেশাজহাদী কে কে চুরি করেছে এটা প্রমাণ করে দেওয়াই আমির আলীর উদ্দেশ্য
এদিকে আমির আলীকে ধরার জন্যে চারদিকে সৈন্য পাঠিয়েছে বাদশাহউজির আর উজিরের ছেলে বাদশাহকে বুঝিয়েছে, শাহজাদীকে চুরি করার কারণেই আমির আলী পালিয়ে গেছেতাকে তার বাড়ীতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নাসেই কথা বিশ্বাস করে বাদশাহ আমির আলীকে বন্দি করার চেষ্টা করছে
আমির আলী বাদশাহর প্রাসাদের কাছে আসতেই উজির ও গাফফার একসাথে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো বাদশাহকেবলতে লাগলো, হুজুর! চোর আমির আলীকে পাওয়া গেছেএকপাশে ভেড়া নিয়ে সে আপনার প্রাসাদের কাছে এসেছেতাকে বেঁধে ফেলার হুকুম দিন হুজুর
বাদশাহ বেরিয়ে এলে আমির আলী বাদশাহকে বললো, আপনার মেয়েকে যদি ফেরত পেতে চান, তাহলে আপনার ঐ উজির আর তার ছেলে গাফফারকে বন্দি করুন হুজুরওদের বন্দি করলেই আপনার মেয়েকে পেয়ে যাবেন আর কে তাকে চুরি করতে গিয়েছিল সেই আসল চোরও পেয়ে যাবেন
বাদশাহ আর করবেন কিমেয়েকে ফেরত পাওয়া যাবে বলে কথামেয়েটাকে পাওয়ার জন্য তিনি সব কিছু করতে রাজীতখনই তিনি সেপাহীদের হুকুম দিলেন ঐ উজির আর তার ছেলেকে বন্দি করার জন্যেহুকুম পেয়েই সেপাইরা তখনই বাপ-বেটা দুইজনকেই বন্দি করে ফেললো
ইতিমধ্যে ঐ যাদকুরটাও কাছে এসে গিয়েছিলএতগুলো ভেড়া এক সাথে দেখে শহরের লোকজনও ্‌অনেক সেখানে এসে জড়ো হয়ে গিয়েছিলআমির আলী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো- এই যে এবার দেখুন এক মজার খেলামাঠের কৃষক ও রাখালদের বাঘে খেয়েছিল, না কিসে খেয়েছিল এবার তা দেখুন-
এই বলেই আমির আলী বাঁশীতে আগুন ধরিয়ে দিলোসঙ্গে সঙ্গে বাঁচাও বাঁচাও বলে আকাশ ফাটানো চিৎকার শুরু করলো শয়তান ঐ যাদুকরটাকিন্তু চিৎকার করলে কি হবে? বাঁশীটা পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যাদুকরটা ভেড়া আর ভেড়াগুলো সব আবার মানুষ হয়ে গেলভেড়া থেকে মানুষ হয়েই শাহজাদী আলেয়া বেগম আব্বা আব্বা বলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বাদশাহকে

দেখে সবাই অবাকঅবাক তো হবেইএত বড় কাণ্ড দেখলে অবাক হয় না কে? অবাক হলেন বাদশাহঅবাক হলো উপস্থিত সকল লোকজন, কিন্তু ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো উজির আর তার ছেলেতারা বুঝতে পারলো শাহজাদী যখন ফিরে এসেছে তাকে চুরি করার সব ঘটনা এবার ফাস হয়ে যাবে
হলোও সব ফাঁসযাদুকরের এই যাদুর সব কথা ফাঁস করে দিলো আমির আলী আর শাহাজাদীকে যে গাফফার জোর করে ধরে নিতে গিয়েছিল, সে কথা ফাঁস করে দিলো শাজহাদীশাহজাদী বললো, ঐ বদমায়েশ উজির জানগণের রাজাকে চিঠি লিখেছিলগাফফার আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে জামনগরে গেলেই জামনগরের রাজা যেন গাফফারের সাথে আমার শাদি দিয়ে দেয়- এই কথা এই উজির সেই চিঠিতে লিখেছিলআমার পালকীর উপর হামলা করার সময় ঐ চিঠিটা গাফফারের পকেট থেকে পড়ে যায়আমি ঐ চিঠি আমার পালকীর ছাদে গুঁজে রেখেছি
পালকীর বাহকেরা এবং পালকীর পাহারাদার সেপাইরাও ভেড়া থেকে মানুষ হয়ে গিয়েছিলতারা এবার সবাই একবাক্যে বদশাহকে বললো- জি হুজুর, শাহজাদী যা বললেন তা সম্পূর্ণ সত্যঐ বদমায়েশ গাফফার অনেক সৈন্য নিয়ে গিয়ে পালকীর উপর হামলা করলে আমরা পালকী নিয়ে কোন মতে পালিয়ে ঐ পাকুরতলায় আসি আর এই ব্যাটা যাদুকরের যাদুর ফাঁদে পড়ে যাই
তখনই লোক পাঠিয়ে ঐ পালকী আর উজিরের ঐ চিঠি আনা হলোদেখা গেল ঘটনা ঠিকউজিরের হাতের লেখা চিঠিআর যায় কোথায়? বাদশাহ তখনই জল্লাদ ডাকলেন এবং উজির ও তার ছেলেকে কতোল করে ফেললেনবাপ-বেটা দুইজনেরই মাথা দেহ থেকে পৃথক হয়ে ধূলার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে লাগলোঅন্যায় কাজের আর ম্যিথা বলার উপযুক্ত শাস্তি পেলো তারা
আর যাদুকর? সে ব্যাটাকেও রেহাই দেওয়া হলো নাতখনই ভেড়া হয়ে যাওয়া যাদকুরকে জবাই করে তার মাংস শেয়াল-কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো হলোযাদুকরকে জবই কারার সাথে সাথে যাদু দিয়ে তৈয়ার করা তার সুড়ঙ্গের ঘরবাড়ী ও গুদাম সব চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল এবং ধূলার সাথে মিশে গেল
আমির আলী ও শাহজাদী আলেয়া বেগমের এরপর সে কি আনন্দতাদের সুখের সীমা অবধি রইলো নাবাদশাহ খুশি হয়ে আমির আলীর সাথে শাহজাদী আলেয়া বেগমের বিয়ে দিয়ে দিলেন এবং রাজ্যটাও তাদের দুইজনকে দিয়ে দিলেনআমির আলী বাদশাহ হয়ে রাজ্য চালাতে লাগলো আর বৃদ্ধ বাদশাহ তার বাঁকি জীবন ইবাদত-বন্দেগী, মানে নামাজ রোজা করে পরম সুখে কাটিয়ে দিলেন

*****
পাকুর গাছের ছায়ায় বসে কাহিনীটা এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল উস্তাদপোঁটলায় হেলান দিয়ে কাহিনীটা শুনে সাগরিদটা প্রশ্ন করলো- তাহলে পাথরের এই ভেড়া, মানে মেড়াটা কে বানিয়েছিল উস্তাদ?
উস্তাদ বললো- বাদশাহ হওয়ার পর ঐ আমির আলীআমির আলীটা তো একজন মস্তবড় পণ্ডিত আর বুজুর্গ লোকআল্লাহর বাণী, অর্থাৎ পাক কোরআন পড়া আর জানা থাকলে পরকালে তো প্রচুর লাভ হয়ইইহকালেও কত বড় উপকার আর লাভ হয় সে কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যেই ঐ আমির আলী সাহেবই এই মেড়াটা বানিয়েছিলমেড়ার মাথায় লাথি মারতে এলে যে জানে না সেও তো কারো না কারো কাছে জেনে নেবে কাহিনীটা
এবার খুশি হলো সাগরিদটাবললো- ঠিক উস্তদ ঠিকসব বুঝতে পেরেছিএবার চলুন উস্তাদ, এখানে অনেক দেরী হয়ে গেলবহুত দূরের পথ, এবার চলুন
 পোঁটলাটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাগরিদটাঅতঃপর পথে নেমে এসে উস্তাদ ও সাগরিদ ফের চলতে শুরু করলো

1 টি মন্তব্য:

  1. প্রিয় রহমত অনেক বেদনা হৃদয়ে। কেন তুমি আজ বন্ধ? কবে থেকে তুমি আবার প্রকাশ পাবে? হাজারো প্রশ্ন মনে।

    উত্তরমুছুন